লেখাটি শুরু করতে চাই সংসদে বাজেট অধিবেশনে বাণিজ্যমন্ত্রীর টিপু মুনশির বক্তৃতা থেকে। বাজারের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সংসদ সদস্যদের তোপের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, ‘সিন্ডিকেট নির্ভর বাজার ব্যবস্থা আমরা চাইলে ভাঙতে পারি। কিন্তু এতে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তা সামাল দেওয়া মুশকিল’।
আমি বলি, এটি একজন শক্তিশালী রাজনীতিকের অসহায় আত্মসমর্পণ। পাশাপাশি তিনি সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, যার মধ্যে দিয়ে তিনি প্রতিনিধিত্ব করলেন কৌশল করে বেঁচে থাকা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের।
আমি আসলে বলার চেষ্টা করছি মানুষ কৌশল করে জীবনযাপন করছেন। যদি ঘুরিয়ে বলি, তাহলে বলতে হবে, প্রত্যেক মানুষ নিজে ঠকছেন, পাশাপাশি অন্যকেও ঠকাচ্ছেন।
আমি নিজেও একজন পেশাজীবী। তাই নিজেকে বোঝানোর জন্য সবসময় বলি, আপাত দৃষ্টিতে চুরির মতো করে যেটা প্রায় সবাই করছেন, সেটার নাম কৌশল। সেই কৌশল দেখতে প্রতারণার মতো। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ যেটার মুখোমুখি হচ্ছেন। যে কারণে কোথাও স্বস্তি নেই।
আমি মনে করি এর মূল কারণ বাজার ব্যবস্থা। ব্যবস্থা না বলে অব্যবস্থা বলাই ভালো। কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ এবং তেল নিয়ে যেসব কাণ্ড হলো এবং হচ্ছে একে কোনো ব্যবস্থাপনা বলতে পারছি না। বড়জোর বলতে পারি পরিকল্পিতভাবে মানুষের পকেট থেকে টাকা বের করে নেওয়ার কৌশল।
যারা এই অব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত স্বয়ং মন্ত্রীই তাদের ভয় পাওয়ার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করলেন। এতে প্রমাণিত হয় যারা এই অস্বস্তি তৈরি করেন, তারা সাধারণ মানুষ নন। তাদের সংখ্যাও কিন্তু স্বল্প। কিন্তু তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের বড় চুরির কারণে ইচ্ছে না থাকা সাধারণ মানুষ ছোট চুরি করতে বাধ্য হন।
অনেকেই বলছেন, আমাদের চাওয়া-পাওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। আর এদের চাওয়ার ধরণ হচ্ছে, ‘কত কম পরিশ্রম করে কত বেশি পাওয়া যায়’। কৌশলের ধার না ধরে গায়ের জোরেই সবকিছু নিজের দখলে নিতে চাচ্ছেন। যে কারণে আমরা বলতেই পারি যে এখন পুঁজিবাদী গায়ের জোরের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে চৌর্যবৃত্তি। আর এই গায়ের জোর পেতে চোরচক্র থাকছেন ক্ষমতার গা ঘেঁষে। যে কারণে তারা এখন রাজনীতিও নিয়ন্ত্রণ করছেন। এটা আর নেওয়া যাচ্ছে না।
পাঠক ভুল বুঝবেন না। মানুষের অস্বস্তির যে বর্ণনা এতক্ষণ ধরে বললাম, এটি কিন্তু আজকের নয়। যে কারণে এই লেখায় সেই অস্থিরতার সূত্র আমি খুঁজতে চাই না। কারণ এর সূত্র খুঁজতে গেলে মনে হতে পারে আমি বোধ হয় কোনো পক্ষ নিচ্ছি এবং বর্তমান অস্থিরতার জন্যে পূর্বসূরিদের ওপর দায় চাপাচ্ছি। আসলে তা নয়।
আমি আসলে পরিষ্কার করে বলতে চাই এই সমস্যা রাজনৈতিক নয়। কারণ বারবার ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে কিন্তু মানুষের জীবনে স্বস্তি আসেনি। প্রতারকদের ব্যানার বদল হয়েছে শুধু।
অব্যবস্থাপনার সুযোগে চৌর্যবৃত্তির শিকার হওয়া এই দেশের মানুষের প্রধান সমস্যা। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান এত সহজ নয়। কারণ বাইরে থেকে আমাদের সমস্যা কেউ বুঝতে পারেন না। আমরা একটা মোড়কের মধ্যে আছি।
আমরা বলছি ২০৪১ সালের মধ্যে মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ডলারের বেশি। বর্তমানে যেটা দেখানো হচ্ছে প্রায় ২ হাজার ডলার।
আমার সামনে পদ্মাসেতু। পেছনে মেট্রোরেল। মানুষের জন্য প্রতি মুহূর্তে উন্নয়নের চমক। তারপরেও স্বস্তি নেই। বলতে দ্বিধা নেই অর্থনৈতিক বণ্টন সুষম নয়।
২ হাজার ডলার মাথাপিছু আয়ের বিপরীতে গার্মেন্টস শ্রমিকের আয় ৫০ থেকে ১শ ডলার। সাধারণ চাকরিজীবীর আয়ও এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই অসাম্য দূর করা না গেলে কোনোভাবেই কী মানুষ আরাম বোধ করবেন?
রাজনৈতিক পথে এর সমাধান আছে বলে মনে করেন বেশিরভাগ মানুষ। ইদানীং একটু বেশি বেশিই করছেন। দেশ বিদেশ থেকে জ্ঞানীগুণী মানুষেরা আসছেন। নানা কিছু দেখে শুনে বলছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনই এসব কিছুর সমাধান। ভাবখানা এমন, যেন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়ে গেলে চারদিকে শান্তির ফল্গুধারা বইবে। আমি জানি না হবে হয়তো। কিন্তু ১৯৯০ পর থেকে সবগুলো নির্বাচন আমার দেখা। আমার অভিজ্ঞতা বলছে, যথা পূর্বাং তথা পরং।
আবারও মাথায় ভিড় করে হাজারও প্রশ্ন, কী হবে আমাদের? কী হবে এই অস্থিরতার সমাধান? আমাদের বাজার থেকে যেভাবে শোষণ করা শুরু হয়েছে তাতে কীভাবে মানুষ বাঁচানো যাবে? যারা এই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না বা প্রতিযোগিতা করবেন না তারা কী দেশ ছাড়বে? নিশ্চয়ই এসব প্রশ্নের ইতিবাচক সমাধান চাই আমরা। তাই এই মুহূর্তে কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো পথ দেখি না। নিয়ন্ত্রণ বলতে আমি বুঝি, চৌর্যবৃত্তি একেবারে বন্ধ করতে হবে।
বন্ধ শব্দটির ওপর জোর দিলাম। কারণ জোর খাটিয়ে মানুষের পকেট কাটা বন্ধ করতে হবে। তাহলে যারা কাজটি করবেন, তাদের হাতে থাকতে হবে পকেটকাটাদের চেয়ে বেশি জোর। এত জোর আসলে রাষ্ট্র ছাড়া কেউ দিতে পারে না।
আমি আসলে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চাইলাম, যারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করবেন, তাদের হাতে রাষ্ট্রীয় শক্তি থাকতে হবে। শুধু শক্তি নয়, থাকতে হবে তথ্য এবং গবেষণা। তাহলে তারা জানবেন, প্রকৃত উৎপাদন, পরিবহন এবং বাজারজাত খরচ।
কোনো পণ্য হঠাৎ বা উধাও হলে তারা বুঝতে পারবেন কেন এমন হলো? সুতরাং বোঝাই যায় আমাদের কল্যাণে কিছু নিয়ন্ত্রিত মানুষ দরকার, যারা কাজ করতে করতে দ্রুত বাজার নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবেন। কিন্তু নতুন করে সেই শৃঙ্খল গ্রুপ তৈরি করতে গেলে সময় দরকার। সেই সময় কী আমাদের হাতে আছে? তাই এই মুহূর্তে দেশে শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে কাজ করছেন, তাদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আমি আর কোনো পথ দেখছি না।
পলাশ আহসান ।। সহযোগী প্রধান বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন