যেখানে অনেকে স্বার্থ ছাড়া কিছুই ভাবেন না, সেখানে এক গরিব মানুষ নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বড় করে দেখছেন অন্যের জীবন। তিনি নিরু মন্ডল—নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার বড়বড়িয়া গ্রামের এক অসুস্থ দিনমজুর। অথচ তিনিই এক বছরের বেশি সময় ধরে একটি অননুমোদিত রেলগেটে গেটম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন একেবারে বিনা পারিশ্রমিকে, শুধুমাত্র মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে।
রাণীনগরের গোনা ইউনিয়নের অনেক গ্রাম রেললাইনের পূর্ব পাশে অবস্থিত। ইউনিয়ন পরিষদে যেতে হলে বড়বড়িয়া, বিজয়কান্দি, আকনা—এমন অন্তত দশটি গ্রামের মানুষকে প্রতিদিন ঘুরে যেতে হয় প্রায় ১৫ কিলোমিটার পথ, যেখানে সরাসরি রাস্তা মাত্র ৪ কিলোমিটার। কারণ, মাঝখানে নেই কোনো অনুমোদিত রেলগেট। আগে এই জায়গায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটত। অনেকেই ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আহত বা নিহত হয়েছেন।
তখনই স্থানীয় মানুষ মিলে বাঁশ দিয়ে তৈরি করে একটি অস্থায়ী রেলগেট। নিজের অসুস্থ শরীর আর অভাবের সংসার ভুলে সেই গেটের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন নিরু মন্ডল।
প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নিরু দাঁড়িয়ে থাকেন গেটের পাশে। ট্রেন আসার শব্দ পেলেই লাঠি-বাঁশ নিয়ে ছুটে গিয়ে যানবাহন ও মানুষদের থামিয়ে দেন, নিশ্চিত করেন নিরাপদ পারাপার। কেউ কেউ তাকে ৫ বা ১০ টাকা দেন, অনেকে কিছুই দেন না। তার নিজের ছোট্ট একটি দোকানও রয়েছে, যেটা দিয়ে কোনোভাবে সংসার চলে। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, দোকানের পুঁজি ফুরিয়ে যাচ্ছে, আর সংসারের খরচ চালানোও কঠিন হয়ে পড়ছে।
নিরু মন্ডলের বলেন, আমি কারও দয়া চাই না। শুধু চাই এই গেটটা যেন বন্ধ না হয়। মানুষের জীবন বাঁচাতে পারলেই আমার শান্তি। কিন্তু এখন আর পারছি না, সাহায্য ছাড়া হয়তো বেশিদিন টিকতে পারব না।
স্থানীয় বাসিন্দা হাসিবুল ইসলাম রাজু বলেন, নিরু না থাকলে আমাদের প্রতিদিন ১৫ কিলোমিটার ঘুরে যেতে হতো। তিনি নিজের জীবন ভুলে মানুষের জন্য কাজ করছেন। আমাদের সবার উচিত তাকে মাসিকভাবে সাহায্য করা।
রেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই গেটটি এখনো অনুমোদিত নয়। তবে আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাকিবুল হাসান জানিয়েছেন, খোঁজখবর নিয়ে নিরুর জন্য কোনো সরকারি সহযোগিতা নিশ্চিত করা যায় কিনা, সেটি বিবেচনা করা হবে।
নিরু মন্ডল শুধু একজন গেটম্যান নন, তিনি মানবিকতার এক জীবন্ত উদাহরণ। তার মতো মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
এমন মহৎ কাজে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবান, জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষেরও সহযোগিতা এখন খুব প্রয়োজন। যেন নিরু তার দায়িত্ব ঠিকঠাক চালিয়ে যেতে পারেন এবং তার নিজের পরিবারও বাঁচে।
ডিএম /সীমা