34842

07/24/2025 ফেনীতে এবারের বন্যায় আর্থিক ক্ষতি ২৩৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা

ফেনীতে এবারের বন্যায় আর্থিক ক্ষতি ২৩৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা

জেলা সংবাদদাতা, ফেনী

২৩ জুলাই ২০২৫ ১১:৩৩

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার বছর না পেরোতে ফের পানিতে ডুবেছে ফেনীর জনপদ। টানা বৃষ্টিপাত ও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার পাঁচটি উপজেলার বিস্তীর্ণ নিম্নাঞ্চল ও নদীতীরবর্তী এলাকা বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। গত ৮ জুলাই থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪১টি অংশ ভাঙনে প্রবল পানির তোড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কৃষি খাত ও অবকাঠামোতে।

জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদন অনুযায়ী বন্যাদুর্গত এলাকায় এবারও কৃষি, সড়ক যোগাযোগ, মৎস্য, প্রাণিসম্পদসহ অন্যান্য খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩৮ কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৩১ টাকা।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় কৃষিখাতে ২ হাজার ৭২৫ দশমিক ৬ হেক্টর জমির শস্যখেত ও বীজতলা নষ্ট হয়ে যায়। এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ৭৫ কোটি ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। কৃষকদের মতে, বছরের পর বছর প্রতি মৌসুমে এমন ক্ষতির মুখে পড়ে খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বন্যার পানিতে ভেসে গেছে মাছের ঘের ও পুকুর। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪৪০ দশমিক ১০ হেক্টর হ্যাচারি ও ১ হাজার ৬৭৭টি পুকুর-জলাশয়। এতে ক্ষতি হয়েছে ৮ কোটি ৩৬ লাখ ২৬ হাজার ১৪৬ টাকা।

প্রাণিসম্পদ খাতেও ব্যাপক ক্ষতির চিত্র উঠে এসেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যায় ৬৬ হাজার ৮২৫টি প্রাণী মৃত ও ভেসে যায়। এর মধ্যে ভেড়া ১৩টি, ছাগল ৩টি, গরু ৯টি ও মুরগি ৬৬ হাজার ৮০০টি। প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ১ কোটি ৩২ লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা।

বন্যায় প্রবল পানির স্রোতে জেলার ৩১৯ দশমিক ৬ কিলোমিটার পাকা-আধাপাকা ও কাঁচা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলজিইডি ও সড়ক বিভাগ জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৬১টি ব্রিজ-কালভার্টসহ অন্যান্য স্থাপনা। অবকাঠামোগত এ ক্ষতির পরিমাণ ৮২ কোটি ৩০ লাখ ৬৯ হাজার টাকা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় অন্তত ৪৩ দশমিক ৩৭৩ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৫৩ কোটি ৮৩ লাখ ৮৯ হাজার ৫০০ টাকা।

এবারের বন্যায় জেলায় ৫১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৭টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ২টি কলেজ ও ২টি মাদরাসা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। স্বাস্থ্য খাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তারমধ্যে ৪টি হাসপাতাল ও ১০টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১৭ লাখ টাকা।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে রয়েছে ৩ হাজার ১৮৮টি গভীর, অগভীর ও হস্তচালিত নলকূপ এবং ২ হাজার ৭৪০টি স্বাস্থ্যসম্মত বাথরুম।

বন বিভাগ জানিয়েছে, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৯ দশমিক ৫ হেক্টর বনায়ন ও ৮ হাজার ২৬টি নার্সারি। এতে ক্ষতির পরিমাণ ১৯ লাখ ৮৭ হাজার ২৩৪ টাকা। বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, বন্যায় ৭৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার বৈদ্যুতিক লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকা।

ফুলগাজীর মুন্সিরহাট এলাকার বাসিন্দা আলী আহম্মদ বলেন, বন্যায় ঘরের জিনিসপত্রের সঙ্গে পুকুরও ভেসে গেছে। বছর বছর একইভাবে আমরা ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। এখানে স্থায়ী টেকসই বাঁধ নির্মাণ না হলে এ দুর্ভোগ কখনো শেষ হবে না।

মো. নিষাদ নামে এক তরুণ উদ্যোক্তা বলেন, এখন ভারী বৃষ্টি না হলেও ভারতের উজানের পানিতে আমরা ভেসে যাচ্ছি। নদীর নাব্যতা সংকট ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার দায়সারা কাজের কারণে এ জনপদে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। আমরা এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই।

এ ব্যাপারে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মাহবুব আলম বলেন, সব ধরনের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির জন্য বরাদ্দ এলে পুনর্গঠন কার্যক্রম শুরু হবে। আংশিক ক্ষয়ক্ষতির ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এনজিও ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ সমন্বয়ে পুনর্বাসনে কাজ করা হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তর তাদের নিজ নিজ ক্ষয়ক্ষতির হিসাব অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। সে অনুযায়ী পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে।

তিনি বলেন, ২০২৪ সালের বন্যা ও এবারের বন্যার অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি জেলায় আরও বেশি আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন। ফেনী এখন একটি বন্যা প্রবণ এলাকা। জেলা প্রশাসন এই বিষয়ে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানাতে উদ্যোগ নিয়েছে।

এর আগে গেল বছরের জুলাই-আগস্টে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ফেনীর জনপদ। তারমধ্যে ১৯ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া বন্যার ভয়াবহতা ছাড়িয়ে গেছে অতীতের সব ইতিহাস। ভয়াবহ এ বন্যায় প্রাণ হারিয়েছিল ২৯ জন। এছাড়াও বন্যায় সড়ক যোগাযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মোটরযান, ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় প্রত্যেক খাতেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে শত কোটি টাকা।

ডিএম /সীমা

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]