২০২৩ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হেনেছিল তুরস্কে। ওই ভূমিকম্পের সময় গুগলের আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে বলে স্বীকার করেছে বৈশ্বিক এই টেক জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানটি।
ভয়াবহ সেই ভূমিকম্পে এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থল এই দেশটিতে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়েছিল। সোমবার (২৮ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্র থেকে প্রায় ১৫৮ কিলোমিটার এলাকার অন্তত ১ কোটি মানুষকে সর্বোচ্চ স্তরের সতর্কবার্তা পাঠানো সম্ভব ছিল। আর সেই সতর্কবার্তা ওই অঞ্চলের মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য ৩৫ সেকেন্ড পর্যন্ত সময় দিতে পারতো।
কিন্তু বাস্তবে, প্রথম ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পের সময় মাত্র ৪৬৯ জনকে এমন ‘টেক অ্যাকশন’ সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। গুগল জানিয়েছে, আরও পাঁচ লাখ ব্যবহারকারীকে হালকা কম্পনের জন্য নির্ধারিত নিম্ন স্তরের সতর্কবার্তা পাঠানো হয়, যা ফোনের পর্দায় তেমনভাবে দেখা যায় না বা জরুরি সাউন্ডে বিরতি ভাঙে না।
গুগল আগে বলেছিল, তাদের সতর্কতা ব্যবস্থা “ভালো কাজ করেছে”। এই প্রযুক্তি অ্যান্ড্রয়েড চালিত স্মার্টফোনে কাজ করে, যা তুরস্কে ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের ৭০ শতাংশের বেশি।
বিবিসি বলছে, ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ-পূর্ব তুরস্কে দুটি শক্তিশালী ভূমিকম্পে ৫৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা যান এবং এক লাখের বেশি আহত হন। অনেকে ঘুমন্ত অবস্থায় ভবনের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান।
ভূমিকম্পের দিন গুগলের সতর্কতা ব্যবস্থা চালু ছিল, তবে সেটি কম্পনের প্রকৃত মাত্রা যথাযথভাবে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়। গুগলের এক মুখপাত্র বলেন, “প্রতিটি ভূমিকম্প থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আমাদের সিস্টেম উন্নত করছি।”
কীভাবে কাজ করে এই সতর্কতা ব্যবস্থা?
গুগলের অ্যান্ড্রয়েড আর্থকুয়াক অ্যালার্টস বা এইএ নামের এই প্রযুক্তি অ্যান্ড্রয়েড ফোনের সেন্সর ব্যবহার করে কম্পন শনাক্ত করে। যেহেতু ভূমিকম্প মাটির নিচ দিয়ে তুলনামূলক ধীরে চলে, তাই আগেই সতর্কবার্তা পাঠানো সম্ভব হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা হলো ‘টেক অ্যাকশন’, যা উচ্চ শব্দে অ্যালার্ম বাজায়, ফোনের ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ মোড ভেঙে পর্দা জুড়ে সতর্কবার্তা দেখায়। এটি তখনই পাঠানো হয় যখন প্রাণনাশের মতো শক্তিশালী কম্পন শনাক্ত হয়। আরেকটি সতর্কবার্তা হচ্ছে ‘বি অ্যাওয়ার’, যা অপেক্ষাকৃত হালকা কম্পনের সময় পাঠানো হয়, তবে সেটি ফোনে এতটা চোখে পড়ার মতোভাবে আসে না।
তুরস্কে প্রথম ভূমিকম্পটি ঘটে ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে। সেসময় অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে ছিলেন। এ অবস্থায় শুধুমাত্র ‘টেক অ্যাকশন’ সতর্কবার্তাই মানুষকে জাগাতে পারতো।
ভূমিকম্পের কয়েক মাস পর এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা যাচাই করতে বিবিসি ভূমিকম্পপীড়িত বিভিন্ন শহরের মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু কেউই বলেননি যে, তারা কম্পনের আগেই ‘টেক অ্যাকশন’ সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন।
প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা
সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত গুগলের গবেষণায় জানানো হয়, প্রথম ভূমিকম্পের সময় সিস্টেমটি কম্পনের মাত্রা মাত্র ৪.৫ থেকে ৪.৯ হিসেবে নির্ধারণ করেছিল, যেখানে প্রকৃত মাত্রা ছিল ৭.৮। সেদিনের দ্বিতীয় ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেও একই রকম ভুল হয়েছিল, তবে তখন ৮ হাজার ১৫৮ জনকে ‘টেক অ্যাকশন’ এবং প্রায় ৪০ লাখ মানুষকে ‘বি অ্যাওয়ার’ সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিল।
পরে গুগল অ্যালগরিদমে পরিবর্তন আনে এবং প্রথম ভূমিকম্পটি পুনরায় সিমুলেট করে। এতে দেখা যায়, নতুন সংস্করণ ১ কোটি মানুষকে ‘টেক অ্যাকশন’ সতর্কবার্তা পাঠাতে সক্ষম হয় এবং আরও ৬ কোটি ৭০ লাখ মানুষকে ‘বি অ্যাওয়ার’ বার্তা পাঠায়।
গুগল বিবিসিকে জানায়, “প্রত্যেক ভূমিকম্প সতর্কতা ব্যবস্থাকেই বড় মাত্রার কম্পনের ক্ষেত্রে অ্যালগরিদমের টিউনিং নিয়ে লড়াই করতে হয়।”
তবে কলোরাডো স্কুল অব মাইনসের সহকারী অধ্যাপক এলিজাবেথ রেড্ডি বলেন, “এই তথ্য প্রকাশে দুই বছরের বেশি সময় লাগায় আমি হতাশ। এটি ছোট কোনো ঘটনা নয়— মানুষ মারা গেছে। কিন্তু এই সতর্কতা ব্যবস্থা আশানুরূপ কাজ করেনি।”
গুগল জানিয়েছে, তাদের প্রযুক্তি জাতীয় সতর্কতা ব্যবস্থার বিকল্প নয়, বরং সম্পূরক। তবে কিছু বিজ্ঞানী আশঙ্কা করছেন, অনেক দেশই হয়তো গুগলের প্রযুক্তির ওপর বেশি নির্ভর করছে, যেটি এখনও পুরোপুরি পরীক্ষিত নয়।
প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট সিসমিক নেটওয়ার্কের পরিচালক হ্যারল্ড টোবিন বলেন, “এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা সম্পর্কে খোলামেলা তথ্য প্রকাশ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেউ কেউ ভাবতে পারে, গুগল যদি সতর্কতা দেয়, তাহলে আমরা কিছু না করলেও চলবে।”
গুগল জানিয়েছে, বিশ্লেষণ থেকে শিক্ষা নিয়ে অ্যান্ড্রয়েড আর্থকুয়াক অ্যালার্টস বা এইএ এখন ৯৮টি দেশে সতর্কতা পাঠাচ্ছে। বিবিসি গুগলের কাছে জানতে চেয়েছে, ২০২৫ সালের মিয়ানমার ভূমিকম্পে এই ব্যবস্থা কেমন কাজ করেছে— তবে এখনো কোনো উত্তর মেলেনি।
ডিএম /সীমা