পবিত্র কোরআনের সুরা আল ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন—
اِنَّ اَوَّلَ بَیۡتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِیۡ بِبَكَّۃَ مُبٰرَكًا وَّ هُدًی لِّلۡعٰلَمِیۡنَ
নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো বাক্কায়, বরকতময় ও সৃষ্টিজগতের দিশারী হিসাবে।
সুরা আল ইমরানের এই আয়াতে কাবাঘরের শ্রেষ্ঠত্বের কয়েকটি বিশেষ দিক বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রথমত : এটি পুরো বিশ্বের মানুষের সর্বপ্রথম ইবাদতের স্থান।
দ্বিতীয়ত : এই ঘর বরকতময় ও কল্যাণের আধার।
তৃতীয়ত : এই ঘর বিশ্বের সব সৃষ্টির জন্য পথপ্রদর্শক।
আয়াতে বর্ণিত প্রথম শ্রেষ্ঠত্বের সারমর্ম এই যে, মানবজাতির জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম যে ঘর নির্দিষ্ট করা হয়, তা ওই ঘর, যা বাক্কা বা মক্কায় অবস্থিত।
অর্থাৎ,মক্কায় অবস্থিত কাবাঘরই বিশ্বের সর্বপ্রথম ইবদাতঘর। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.), মুজাহিদ, কাতাদাহ, সুদ্দী প্রমুখ সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতে, ইতিপূর্বে কোন উপাসনালয়ও ছিল না এবং বাস গৃহও ছিল না। এ কারণে কাবাই বিশ্বের সর্বপ্রথম গৃহ।
এক হাদিসে বর্ণিত, হজরত আবু জর (রা.) রাসুল (সা.)-কে একবার জিজ্ঞেস করেন যে, জগতের সর্বপ্রথম মসজিদ কোনটি? তিনি বললেন, মসজিদুল হারাম। আবারো প্রশ্ন করা হলো : এরপর কোনটি? তিনি উত্তর দিলেন : মসজিদে বায়তুল-মুকাদ্দাস। আবার জিজ্ঞাসা করলেন : এই দুটি মসজিদ নির্মাণের মাঝখানে কতদিনের ব্যবধান ছিল? তিনি বললেন : চল্লিশ বৎসর। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৬৬, মুসলিম, হাদিস : ৫২০)
হজরত আদম (আ.) সর্বপ্রথম কাবাঘর নির্মাণ করেছেন। আবার কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, আদম (আ.)-এর হাতে নির্মিত কাবাঘর হজরত নুহ(আ.)-এর মহাপ্লাবন পর্যন্ত অক্ষত ছিল। মহাপ্লাবনে কাবাঘর বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এরপর ইবরাহিম (আ.) প্রাচীন ভিত্তির ওপর কাবাঘর পুনঃনির্মাণ করেন।
পরবর্তীকালে এক দুর্ঘটনায় কাবার প্রাচীর ধ্বসে গেলে জুরহাম গোত্রের লোকেরা একে পুনঃনির্মাণ করেন। এভাবে কয়েক বার বিধ্বস্ত হওয়ার পর একবার আমালেকা সম্প্রদায় ও একবার কুরাইশরা কাবাঘর নিৰ্মাণ করে। সর্বশেষ রাসুল (সা.)-ও কাবার নির্মাণে অংশ নিয়েছিলেন এবং তিনিই ‘হাজরে-আসওয়াদ' স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু কুরাইশদের এই নির্মাণের ফলে ইবরাহিম (আ.)-এর নির্মিত ভিত্তি সামান্য পরিবর্তিত হয়ে যায়।
প্রথমত : কাবার একটি অংশ হাতীম কাবা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত : ইবরাহীম আলাইহিস সালামের নির্মাণে কাবা গৃহের দরজা ছিল দুটি- একটি প্রবেশের জন্য এবং অপরটি বের হওয়ার জন্য। কিন্তু কুরাইশরা শুধু পূর্বদিকে একটি দরজা রাখে।
তৃতীয়ত : তারা সমতল ভূমি থেকে অনেক উঁচুতে দরজা নির্মাণ করে- যাতে সবাই সহজে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে; বরং তারা যাকে অনুমতি দেবে সেই যেন প্রবেশ করতে পারে।
হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার আয়েশা (রা.)-কে বলেছিলেন, আমার ইচ্ছা হয়, কাবাঘরের বর্তমান নির্মাণ ভেঙ্গে দিয়ে ইবরাহীমী নির্মাণের মতো করে দেই। কিন্তু কাবাঘর ভেঙ্গে দিলে নও-মুসলিম অজ্ঞ লোকদের মনে ভুল বুঝাবুঝি দেখা দেয়ার আশংকার কথা চিন্তা করেই বর্তমান অবস্থা বহাল রাখছি। (বুখারি, হাদিস : ৪৪৮৪, ১৫৮৩, মুসলিম, হাদিস : ১৩৩৩)
এ কথাবার্তার কিছুদিন পরেই রাসুল (সা.) ইন্তেকাল করেন। কিন্তু আয়েশা (রা.)-এর ভাগ্নে আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। খেলাফায়ে রাশেদীনের পর যখন তিনি মক্কার দায়িত্ব পেলেন তখন তিনি নবীজির ইচ্ছামতো ইবরাহীমী নির্মাণের মতো করে কাবাঘর সংস্কার করেন।
কিন্তু এর কিছুদিন পর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ মক্কায় সৈন্যাভিযান করে তাকে শহীদ করে দেয়। সে কাবাঘর আবার ভেঙ্গে জাহেলিয়াত আমলে কুরাইশরা যেভাবে নির্মাণ করেছিল, সেভাবেই নির্মাণ করে।
হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের পর কোন কোন শাসক কাবাঘরের এই কাঠামো ভেঙে রাসুল (সা.)-এর মনের ইচ্ছার মতো নির্মাণ করতে চান। তারা এ বিষয়ে ইমাম মালেক ইবনে আনাস (রহ.)-এর কাছে ফতোয়া চান।
তিনি এভাবে কাবাঘর ভাঙা-গড়ার বিপক্ষে মতামত দিয়ে বলেন—
এভাবে বারবার কাবাঘর ভাঙ্গা-গড়া অব্যাহত থাকলে পরবর্তী শাসকদের জন্য একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে এবং কাবাঘর তাদের খেলনায় পরিণত হবে। বৃহত্তর স্বার্থে তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্মাণ কাঠামোর ওপরই কাবাঘর রাখার পক্ষে মতামত দেন। মুসলিম বিশ্ব তার এই ফতোয়া গ্রহণ করে। ফলে আজ পর্যন্ত হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের নির্মাণই অবশিষ্ট রয়েছে। তবে মেরামতের প্রয়োজনে ছোটখাটো সংস্কার কাজ সব সময়ই অব্যাহত থাকে।