35900

08/09/2025 স্ক্রিনে আবদ্ধ শৈশব, স্মার্টফোন নির্ভরতা কি নতুন ব্যাধি?

স্ক্রিনে আবদ্ধ শৈশব, স্মার্টফোন নির্ভরতা কি নতুন ব্যাধি?

ড. জেসান আরা

৯ আগস্ট ২০২৫ ১০:৩৮

বিশ্বজুড়ে স্মার্টফোন এখন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। তবে এর ব্যাপক ব্যবহারের ফলে স্মার্টফোন আসক্তি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই কম-বেশি এই সমস্যার শিকার। এই প্রযুক্তি স্মার্টফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশন, ট্যাবলেট কিংবা গেম কনসোলের প্রতি নিয়মিত ও অতিরিক্ত নির্ভরতা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

রাজধানীর নামকরা একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র রাফি ইসলাম (ছদ্মনাম)। বয়স ১৫ বছর। কিন্তু তার আচরণে যেন একটি নতুন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। একটি প্রজন্ম, যারা বড় হচ্ছে স্মার্টফোনের আলো-আঁধারিতে। রাফির মা শারমিন আক্তার বলছিলেন, “আগে স্কুল থেকে ফিরেই আমার সঙ্গে গল্প করতো আজ কী শিখল, ক্লাসে কী হলো, বন্ধুদের সঙ্গে কী খেলল। এখন বাসায় ফিরে সে যেন আর আমাদের বাড়ির কেউ না। সরাসরি মোবাইল চায়, না পেলে রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দেয়, পড়তে চায় না।”

রাফির এই অভ্যাস আজকের বিষয় নয়। চার বছর ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তার এই মোবাইল নির্ভরতা। মা অথবা বাবার ফোন নিয়ে ইউটিউব দেখা, ভিডিও গেম খেলা, টিকটক বা ফেসবুকের ভিডিও স্ক্রল করে সময় কাটানোই যেন তার নতুন জীবনযাপন। শত নিষেধ-বারণেও থামছে না এই আসক্তি। এমনকি সম্প্রতি সে নিজের একটি স্মার্টফোন চেয়ে চাপ দিচ্ছে মা-বাবাকে। আর তা না পেলে তার ‘সাবধানবাণী’ কিছু খাবে না, পড়ালেখা করবে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা যখন বয়সের তুলনায় বেশি সময় মোবাইল স্ক্রিনে কাটাতে থাকে, তখন তা তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশুরা হয়ে পড়ে একাকী, আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বল, ঘুমের সমস্যা হয়, এমনকি শারীরিক কার্যকলাপ কমে গিয়ে স্থূলতা দেখা দেয়।

তারা বলেন, “এটি নিছক কোনো খারাপ অভ্যাস নয়। এটি এখন একধরনের ‘ডিজিটাল অ্যাডিকশন’। শিশুরা যদি দৈনিক দুই ঘণ্টার বেশি সময় মোবাইল স্ক্রিনে ব্যয় করে, তাহলে তার শরীর ও মন দুটোর ওপরই ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। অথচ শহরাঞ্চলের অনেক শিশুর ক্ষেত্রেই এই সময়সীমা ৫-৬ ঘণ্টা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।”

সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পড়াশোনার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু এর সুযোগ নিতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে বিনোদনের দিকে। রাফির মতো অনেকই এখন অনলাইনে ক্লাসের নাম করে ইউটিউব বা গেমে ব্যস্ত থাকে।

ঢাকার একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষক জানালেন, ‘আমরা অনলাইন ক্লাসের সময় একাধিকবার দেখেছি, শিক্ষার্থীরা পড়ার সময় স্ক্রিনের অন্য ট্যাবে গেম চালু করে রেখেছে। এটা আমাদের জন্যও উদ্বেগজনক।’

২০২০ সালের শুরুতে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে শিক্ষার্থীদের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন আসে। অনলাইন শিক্ষার প্রসার, বাইরে যাওয়া বন্ধ হওয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সব মিলিয়ে স্মার্টফোন শিক্ষার্থীদের জীবনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। এই সময়ে স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার বেড়ে যায়, যা স্মার্টফোন আসক্তির ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়।
বড়দের ক্ষেত্রে এই আসক্তি বিভিন্ন ব্যক্তিগত মানসিক ও পরিবেশগত কারণে তৈরি হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে উদ্বেগ, একাকীত্ব এবং মানসিক চাপ জমতে জমতে এমন এক অবস্থায় পৌঁছায়, যেখানে তারা বাস্তবতা থেকে পালাতে ফোনকে আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করে।

আবার দীর্ঘদিন ধরে এর ব্যবহার অভ্যাসে পরিণত হলে আসক্তিতে রূপ নেয়। এছাড়াও স্মার্টফোন অ্যাপস ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অবিরাম সংযোগ ও মুঠোফোন-ভিত্তিক সুবিধা পাওয়া যায়, যা ব্যবহারকারীদের ফোন থেকে দূরে থাকতে দেয় না। এর অভ্যাসগত ব্যবহারের ফলে সামনাসামনি যোগাযোগের সুযোগ কমিয়ে দেয়, মনোযোগ বিচ্যুতি ঘটায়, ঘুমের সময় কমিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

২০২০ সালের শুরুতে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে শিক্ষার্থীদের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন আসে। অনলাইন শিক্ষার প্রসার, বাইরে যাওয়া বন্ধ হওয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সব মিলিয়ে স্মার্টফোন শিক্ষার্থীদের জীবনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। এই সময়ে স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার বেড়ে যায়, যা স্মার্টফোন আসক্তির ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষরা সাধারণত গেম খেলা ও ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিমগ্ন থাকে, যা থেকে পালিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। আর নারীরা বেশি ব্যবহার করে যোগাযোগ ও আবেগগত সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য। তবে সামাজিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ থাকলে তারাও বেশি আসক্ত হয়ে পড়ে।

আর এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার উপায় নেই প্রযুক্তির সুবিধার পাশাপাশি এর অপব্যবহার আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট, কম্পিউটার এবং টেলিভিশনের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের শরীর ও মনের ওপর নানা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

১. মানসিক প্রভাব: একাকীত্ব, অস্থিরতা, উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দিতে পারে। মনোযোগে ঘাটতি হয় এবং পড়াশোনায় আগ্রহ কমে যায়। ঘুমের সমস্যা দেখা দেয়, বিশেষ করে রাত জেগে স্ক্রিন ব্যবহার করলে।

২. শারীরিক প্রভাব: চোখের সমস্যা (ড্রাই আই, চোখ জ্বালা করা) এবং চোখের ওপর চাপ পড়ে। ঘাড়ে ব্যথা বা সার্ভিক্যাল স্পাইন সমস্যার ঝুঁকি তৈরি হয়, পিঠ এবং কাঁধে ব্যথা, স্থূলতা (ওজন বেড়ে যাওয়া), যেহেতু শরীরচর্চা কমে যায়। পেশির টান, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

৩. সামাজিক প্রভাব: পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল হতে পারে, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার পরিকল্পনাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যায়, একাকিত্ব গ্রাস করে এবং সামাজিক যোগাযোগ কমে যাওয়ায় সামাজিক দক্ষতা কমে যায়।

৪. ইন্টারনেট নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনা: সারাক্ষণ ইন্টারনেটে কী দেখা যায় বা কখন আবার অনলাইনে আসা যাবে, এই চিন্তায় মগ্ন থাকে। যার কারণে অন্যান্য কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলে কখন সময় কেটে যায় তা অনেকে টেরই পায় না। তারা এতটাই মগ্ন হয়ে পড়ে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেলেও খেয়াল করে না।

৫. সাইবার সেক্স আসক্তি: এই ধরনের আসক্তিতে অনলাইনে যৌন বিষয়বস্তুর প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ দেখায় কিংবা ভার্চুয়াল যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলে। এটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও মানসিক স্বাস্থ্যে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা স্মার্টফোন আসক্তির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত। এর প্রধান কারণ হচ্ছে একদিকে যেমন শিক্ষাগত চাপ, অন্যদিকে তেমনি স্মার্টফোনের বহুমুখী ব্যবহার যেমন পড়াশোনা, সামাজিক যোগাযোগ, এমনকি গেম খেলার মতো বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেও এর ভূমিকা।

এই বয়সটা (প্রায় ১৮-২৪ বছর) জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যেখানে ব্যক্তি নিজের পরিচয় গঠনে ব্যস্ত থাকে এবং অন্যদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের প্রবল চাহিদা অনুভব করে। এই সামাজিক চাহিদা পূরণ ও মানসিক চাপ থেকে মুক্তির জন্য তারা অতিরিক্তভাবে স্মার্টফোনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

স্মার্টফোন সবসময় হাতের নাগালে থাকায় তা মুহূর্তেই তাৎক্ষণিক আনন্দ বা সন্তুষ্টি প্রদান করতে সক্ষম হয়। হোক সেটা সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও দেখা কিংবা গেম খেলা। কিন্তু এই স্বল্পমেয়াদি আনন্দ ধীরে ধীরে মানসিক চাপ, অস্থিরতা এবং শেষ পর্যন্ত নির্ভরতা ও আসক্তিতে পরিণত হয়।

এছাড়াও শিক্ষার্থীদের জীবনে বিভিন্ন চাপ রয়েছে, যেমন পড়ালেখা ও চাকরি সংক্রান্ত চাপ, আর্থসামাজিক সমস্যা, এই সবকিছুই উদ্বেগ ও মানসিক চাপ বাড়িয়ে তোলে। এই ধরনের চাপ ও নেতিবাচক আবেগ যেমন মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করে, ঘুমের সমস্যা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া এবং আত্মহত্যার ঝুঁকি পর্যন্ত তৈরি করতে পারে।

শিক্ষার্থীদের একাডেমিক প্রতিযোগিতা, পারিবারিক ও সামাজিক চাপ, সামাজিক যোগাযোগের অভাব এইসব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বর্তমানে একটি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। এই নেতিবাচক আবেগগুলো শিক্ষার্থীদের মানসিক শান্তি ব্যাহত করে এবং বাস্তব জগত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এর ফলে স্মার্টফোন আসক্তি, উদ্বেগ ও মানসিক চাপ শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য, সুখ এবং ভবিষ্যৎ জীবনযাত্রায় গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

আজকের ডিজিটাল জগতে শিশু-কিশোরদের সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন অনেক অভিভাবক, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা এর জন্য প্রস্তুত নন, কারণ তারা নিজেরা এমন প্রযুক্তিনির্ভর পরিবেশে বড় হননি। তাদের শৈশবে এই ধরনের স্ক্রিন-নির্ভরতা ছিল না, তাই সন্তানের সঙ্গে মিল খুঁজে পরামর্শ দেওয়া, সঠিক নিয়ম তৈরি করা বা স্ক্রিন টাইমের সীমা নির্ধারণ করার মতো অভিজ্ঞতা তাদের নেই।

তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকেও প্রযুক্তি শিক্ষার পাশাপাশি ‘ডিজিটাল স্বাস্থ্য’ বিষয়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করা জরুরি। পাশাপাশি প্রয়োজন অবসর সময়ের গঠনমূলক বিকল্প খেলা, বই পড়া, সাংস্কৃতিক চর্চা ইত্যাদির প্রতি আগ্রহ তৈরি করা। যদি সমস্যাটি গুরুতর হয় (যেমন রাফির ঘন ঘন রেগে যাওয়া, আত্মনিয়ন্ত্রণ হারানো), তাহলে তার জন্য একজন অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়মিত সেশন নেয়া গুরুত্বপূর্ণ।

রাফির মতো শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এরা একদিকে প্রযুক্তির সুবিধা নিচ্ছে, আবার অন্যদিকে তার অপব্যবহারে বিপর্যস্ত হচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ মানসিক ও সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করতে হলে এখনই সময় পরিবার, বিদ্যালয় ও সমাজকে একত্রে সচেতনভাবে এগিয়ে আসার।

ড. জেসান আরা : সহযোগী অধ্যাপক ও চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]