অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে দায়িত্ব হস্তান্তর করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। একইসঙ্গে তিনি বলেন, পাকিস্তান ও চীনের মতো ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে আছে নেপাল ও ভুটান। এতে ভারতের সেভেন সিস্টার্সও থাকতে পারে এবং বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে সুবিধা ভাগাভাগি করে নিতে পারে।
বুধবার সিঙ্গাপুরভিত্তিক সিএনএ টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। ওই সাক্ষাৎকারটি এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: প্রফেসর ইউনূস আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। আজ আমরা এই সাক্ষাৎকার রেকর্ড করছি ১৩ই আগস্ট। অর্থাৎ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের এক বছর আট দিন এবং আপনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচিত হওয়ার এক বছর ও সাত দিন আজ। এছাড়াও আপনি ওই পদে শপথ নেয়ার এক বছর পাঁচ দিন আজ। ওই সময় আপনার সামনে কমপক্ষে চারটি খুব নির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল। আপনি কি সেই লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে পেরেছেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এটি কখনও সম্পূর্ণরূপে শেষ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এটাকে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছি আমরা। নিজেরা স্থির করা লক্ষ্যগুলো অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছি। একটি লক্ষ্য ছিল সংস্কার- অনেক কিছু সংস্কারের প্রয়োজন। কারণ আমাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা ইত্যাদিসহ যেসব ব্যবস্থা পেয়েছি তার সবই ছিল জালিয়াতির, সব কিছুর ছিল অপব্যবহার এবং শোষণ- যাতে একটি ফ্যাসিস্ট সরকার তৈরি হয়। ওই সরকার এই সুযোগ নিয়েছে। পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে। বাংলাদেশের সমাজকে নষ্ট করেছে। যখন আমরা সরকারি দায়িত্ব নিলাম, তখন আমরা দেখেছি রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্পের পর ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মতো পরিস্থিতি, সবকিছু ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন: তাই যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের বিষয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, অন্তত গত বছরের গণঅভ্যুত্থানে এবং সম্ভবত তার আগেও গণতান্ত্রিক সংস্কার, শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবেন। পরিশেষে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে নিশ্চিত করবেন যে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। সেটা আপনি পরবর্তী সরকারের হাতে দিয়ে যাবেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমাদের অঙ্গীকার ছিল এই গণঅভ্যুত্থানের সময় জনগণের কাঙ্ক্ষিত সংস্কার, গণঅভ্যুত্থানের সময় তারা জাতির প্রতি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা নিশ্চিত করা। তাদেরকে এই তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। তা হলো সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন।
প্রশ্ন: অবশ্যই এটা কঠিন কাজ। সম্ভবত এ জন্যই অর্ডার সম্ভবত অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেউ অনির্দিষ্টকালের জন্য তর্ক করতে পারে যে কোনটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ- প্রথমে নির্বাচন, তারপরে সংস্কার। প্রথমে সংস্কার, তারপরে নির্বাচন। সম্ভবত এটিই একটি কারণ যার জন্য বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে তাৎক্ষণিক অগ্রগতির অভাব রয়েছে, যারা আপনার সরকারে অবদান রাখছে নির্বাচন কখন হবে এবং আপনি কী ধরনের নির্বাচন চান সে বিষয়ে এক ধরনের ঐক্যে পৌঁছাতে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: একবার ভাবুন তো, যদি আমরা নির্বাচন দিয়ে শুরু করি তাহলে আমাদের সংস্কারের প্রয়োজন নেই, বিচারের প্রয়োজন নেই। কারণ আমাদের পক্ষ থেকে নির্বাচন হলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তাহলে সবকিছু নির্বাচিতদের হাতে চলে যাবে। কল্পনা করুন, অন্য দুটি কাজ না করেই আপনার নির্বাচন হয়েছে। তারপর আপনি আবার সেই পুরনো সমস্যায় ফিরে যাবেন।
প্রশ্ন: আপনি এটাকে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা বলছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: হ্যাঁ, অবশ্যই।
প্রশ্ন: এটা কোন দিক দিয়ে ফ্যাসিবাদ? এটা কি ফ্যাসিবাদী ছিল?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: এটি একটি ফ্যাসিবাদ। কারণ এটি কোনো আইনের শাসন তৈরি করে না।
প্রশ্ন: যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশ ছেড়ে গেলেন তখন তাকে আপনি একটা দানব বলেছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: যদি আপনার কাছে এক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী কোনো শব্দ থাকতো তাহলে আমি সেটাই ব্যবহার করতাম। (এর কারণ) তিনি রাস্তায় খুব কাছ থেকে মানুষ হত্যা করেছেন।
প্রশ্ন: সাবেক (ওই) প্রধানমন্ত্রীর কী হয়েছে, তা দেখা যাক। গত বছরের ৫ আগস্ট তিনি ভারতে পালিয়ে যান। শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য আপনি ভারতের কাছে মৌখিক আবেদন করেছেন। কিন্তু ভারত তাকে ফেরত দেয়নি। আমার মনে হয় আপনি স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ভারত তাকে আতিথেয়তা দেবে কিনা, সেটা আপনার চিন্তার বিষয় নয়। কিন্তু আপনি চান ভারত যেন তার বার্তা প্রচারের জন্য তার বর্তমান অবস্থানকে ব্যবহার করা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু সেটা হচ্ছে না, তাই না?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আপনি আমার কথাকে ঠিকভাবেই উদ্ধৃত করেছেন। আমি ঠিক এটাই বলেছি। হাসিনাকে ভারত থেকে বের করে দেয়ার জন্য আমরা কোনও যুদ্ধে জড়াবো না। আমরা (ভারতকে) বলেছি যে, তোমরা তাকে রাখতে পারো। আমাদের বিচার চলবে। বিচারই তার ভাগ্য নির্ধারণ করবে। কিন্তু ইতোমধ্যে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার কোনও সুযোগ দেয়া উচিত নয়।
প্রশ্ন: ভারতের সাথে সম্পর্কের বিষয়ে আমার মনে হয় আপনি বলেছেন যে, বাংলাদেশের মানচিত্র না আঁকলে ভারতের মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। আসলে, প্রতিটি (দেশ) একে অপরকে তার অস্তিত্বের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করে। আপনার ভাষায়, দেশ দুটি গভীরভাবে একত্রিত।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই। আমি এটা লাখ লাখ বার বলেছি।
প্রশ্ন: আমার দিক থেকে নয়, সমালোচনা আছে যে- অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে চীন ও পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের তুলনায় পিছিয়ে গেছে ভারতের সম্পর্ক।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: কোনটা কী, তা কীভাবে পরিমাপ করব তা আমি জানি না। তবে অবশ্যই আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে। পাকিস্তান, চীনও ভারতের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে চায়। আমরা কখনও বলিনি যে, আমরা ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই না। শুধু বলছি সমস্যাগুলো কী? আমরা এমনকি ব্যাখ্যা করতে থাকি যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এত বিস্তৃত অর্থনীতি যা আমরা গড়ে তুলতে পারি। কারণ আমরা নেপাল এবং ভুটানকে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে আনতে পারি এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্স বা সাতটি রাজ্যও এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে থাকতে পারে। কারণ আমরা বঙ্গোপসাগরের মাধ্যমে একই সুবিধা ভাগ করে নিতে পারি।
প্রশ্ন: যদি আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয় তাহলে এখন আগস্ট মাস। চার মাস, দুই মাস, ছয় মাস, ধরে নিচ্ছি প্রচারণার জন্য সময় আলাদা করা হয়েছে। এতে সক্রিয় শাসনব্যবস্থা থেকে সময় নিয়ে নেবে। এই বাকি সময় এবং আপনি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, একটি বৈধ নির্বাচিত সরকার আসার পরে আপনি আর থাকতে চান না।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: এটা বৈধ নির্বাচন হওয়াই ভালো। অন্যথায়, নির্বাচন করার কোনো মজা নেই। তাই যদি আপনি কিছু ভুল করেন, তাহলে তাকে নির্বাচন বলা উচিত নয়।
প্রশ্ন: এই প্রতিষ্ঠানগুলো যখন নতুন সরকার নির্বাচন করবে, তখন সেই সরকার টেকসই হবে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য আপনি কি পর্যাপ্ত সংস্কার করেছেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমি আপনাকে নিশ্চিত করতে পারছি না যে এটাই রাজনীতি, এটা কীভাবে হবে। এটাই রাজনীতিবিদদের কাজ। আমার কাজ হলো একটি শালীন, গ্রহণযোগ্য, পরিষ্কার, উপভোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা। যারা ভোটার তারা সবাই তাদের ভোট দিতে পারেন। কারণ আমাদের ভোটাররা গত ১৫ বছর ধরে ভোট দিতে পারেননি।
প্রশ্ন: আপনি এটাকে একটা সুন্দর নির্বাচন বলছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: অবশ্যই সুন্দর নির্বাচন। সবাই এতে অংশগ্রহণ করছে। আমি বলেছি এটি একটি মেলার মতো হওয়া উচিত। একটি গ্রামীণ মেলা। তাতে মজা করুন এবং নির্বাচন করুন। এতে কোনও ধরনের উত্তেজনা বা টেনশন থাকবে না।
প্রশ্ন: আমার মনে হচ্ছে আমি এখানে আপনার সঙ্গে চিটিং করছি। এটা শেষ প্রশ্ন নয়। আরও একটি প্রশ্ন আছে। আমার ধারণা, এক বছর পাঁচ দিন ধরে যে কোনও নেতার জন্য, যাদেরকে বিভিন্ন ধরনের কাজ সম্পন্ন করতে হবে, তাদের জন্য এটি খুব কঠিন কাজ। তখন থেকে এখন পর্যন্ত আপনার আকাঙ্ক্ষার কি পরিবর্তন হয়েছে। আপনি কি করতে পারবেন বলে ভেবেছিলেন? এবং এখন আপনি বুঝতে পারছেন যে হয়তো অতিরিক্ত বিষয় ছিল এসব, ধরে নিচ্ছি যে কিছু পরিবর্তন হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস: আমার আর কোনো বিকল্প ছিল না। শুরুতে, যখন আমাকে দায়িত্ব নিতে এবং সরকার গঠন করতে বলা হয়, তখন আমি বাংলাদেশ থেকে দূরে ছিলাম। আমি জানতাম কী ঘটছে, কিন্তু আমার সাথে এমন কিছু ঘটবে বলে আমি আশা করিনি। ছাত্ররা আমাকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছিল। আমি তৎক্ষণাৎ না বলেছি। আমি মনে করি এইভাবে আমি এই পদটি গ্রহণ করতে পারব না। তৃতীয় দিনে তারা আমার কাছে অনুনয় করে বলে এত রক্তপাত হয়েছে, এত ত্যাগ স্বীকার করা হয়েছে। আপনি দেশ থেকে দূরে আছেন। আপনি নিজের জীবন উপভোগ করছেন। আপনাকে আমাদের দরকার। আর আপনি বলছেন না। তাদের এই কথা আমাকে এমনভাবে অনুভূতিতে আঘাত করেছে যে, আমি বলি ঠিক আছে, আমি রাজি। আমি দায়িত্ব গ্রহণ করবো। তাদের এত ত্যাগ স্বীকার করার পর আমারও নিজের কিছু করা উচিত।