প্রতিদিনই কমছে আলুর দাম। গায়েবের পথে মূলধন। ফলে হিমাগারে সংরক্ষিত আলু নিয়ে মহাবিপাকে পড়েছেন জয়পুরহাটের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। সেখানকার ১০০০-১১০০ মূল্যের এক বস্তা (৬৫ কেজি) আলুর বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৬২০ থেকে ৬৫০ টাকায়। হিমাগার ভাড়া বাদ দিয়ে কৃষক পাচ্ছেন মাত্র ২২০ থেকে ২৩০ টাকা। দুই সপ্তাহ আগে আলুর দাম ছিল ৭২০ টাকা বস্তা, এ সপ্তাহে ৬২০।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আলু কিনেই তাদের লোকসান গুণতে হচ্ছে। ক্রয়-বিক্রয়ও খুব ধীরগতিতে চলছে। ফলে হিমাগারের মজুদ কমছে না। গত বছর এ সময়ে হিমাগার থেকে মজুতের অর্ধেক আলু বিক্রি হলেও বর্তমানে মজুতের ৮ শতাংশেরও কম আলু বিক্রি হয়েছে বলে জানায় হিমাগার কর্তৃপক্ষ। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের লোকসানের পাশাপাশি আলু নিয়ে দুশ্চিন্তায় হিমাগার মালিকরাও।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এবার ৪৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৬৩ হাজার মেট্রিক টন। এ জেলায় আলুর চাহিদা ৫০ হাজার মেট্রিক টন। ২১টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণ হয়েছে ২ লাখ ৬ হাজার মেট্রিক টন। আলুর উৎপাদন বেশি হওয়ায় মৌসুমের শুরু থেকেই জেলার বিভিন্ন বাজারে এবার আলুর আশানুরূপ দাম পাননি কৃষকরা।
গত বছর আলু চাষ করে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়েছেন। যার জন্য এবার হিমাগারে কৃষকদের পাশাপাশি অধিকাংশ আলু মজুদ করেছে ব্যবসায়ীরা। হিমাগারে মজুদের সময় ৬৫ কেজির এক বস্তা আলুতে খরচ হয়েছে ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা। এর সঙ্গে হিমাগার ভাড়া ৪০০ টাকা যোগ করলে প্রতি বস্তায় ব্যবসায়ীদের খরচ পড়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা।
সংরক্ষণের চার মাস পর সেই আলু জাত ভেদে বিক্রি হচ্ছে ৬২০ থেকে ৬৩০ টাকা বস্তা। এতে ব্যবসায়ীদের লোকশান গুণতে হচ্ছে বস্তাপ্রতি ৮৮০ থেকে ৯০০ টাকা। আর কৃষক পাচ্ছন হিমাগার ভাড়া বাদে ২২০ থেকে ২৩০ টাকা।
মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বলছেন, হিমাগার থেকে আলু কিনে তাদেরও লোকসান হচ্ছে। চাহিদা কম থাকায় পাইকারি বাজারে দিন দিন দাম কমছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আলু বিক্রি করে কৃষকরা হয়তো হিমাগার ভাড়াও দিতে পারবেন না। দাম কম জেনে কৃষকরা আলু বিক্রি করতেও আসছেন না। মজুত বেশি থাকায় আলু নিয়ে দুশ্চিন্তায় হিমাগার মালিকরাও।
কালাই কাজীপাড়ার কৃষক হাসান আলী বলেন, ‘শিমুলতলী আর.বি স্পেশালাইজড স্টোরেজে ৫০ বস্তা আলু রেখেছি। দাম কম, তাই এখনো বিক্রি করিনি। এই আলু মৌসুমেই বিক্রি হয়েছে প্রতি মণ ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। চার মাস পর হিমাগারে রাখা ৬৫ কেজির এক বস্তা আলু বিক্রি হচ্ছে ৬২০ থেকে ৬৩০ টাকা পর্যন্ত। এই দামে আলু বিক্রি করলে ৫০ বস্তায় লোকসান হবে ৫০ হাজারের বেশি। অথচ আমন ধান রোপনের খরচ জোগাতেই তিনি হিমাগারে এই আলু রেখেছিলেন। আলুর দাম নিয়ে বিপদে অন্য চাষিরাও।
পাঁচবিবি উপজেলার চাটখুর গ্রামের কৃষক মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘লাভের আশায় ১০০ বস্তা আলু রেখে চার মাস পর বিক্রি করে টাকা পেলাম মাত্র ২২ হাজার। এর মধ্যে হিমাগারে রাখার সময় প্রতি বস্তা ক্রয় করেছি ৮০ টাকা, বস্তা প্যাকেট করে ওজন ও সুতলি বাবদ খরচ হয়েছে ৩৫ টাকা, হিমাগারে পৌঁছানোর খরচ হয়েছে ৫০ টাকা। সবমিলিয়ে প্রতি বস্তায় ১৬৫ টাকা করে আগেই খরচ হয়েছে। আগের খরচ বাদে ১০০ বস্তা আলু বিক্রি করে পেলাম মাত্র ৫ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ মৌসুমের সময় বিক্রি করলে এই আলুর দাম পাওয়া যেত ৬০ হাজার টাকা। এ অবস্থায় আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে।’
পুনট বাজারের আলু ব্যবসায়ী মিঠু ফকির বলেন, ‘আলুর দাম বেশি হলে সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির লোকজন দাম কমানোর চাপ দিয়ে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করেন। অথচ এবার আলুর দাম বাড়ানো নিয়ে কারও কোসো মাথাব্যথা নেই।’
আরেক ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন বলেন, ‘বস্তাপ্রতি ৬২৫ টাকা দরে ৩০০ বস্তা আলু কিনেছি। কুমিল্লার পাইকারি বাজারে আলুগুলো পাঠাবো। মহাজন বলছেন, আলুর দাম কমে গেছে। কাঁচামাল বাইরে রাখাও সম্ভব নয়। লোকসান হলেও বিক্রি করতেই হবে। আলু নিয়ে কৃষকের মতো আমরাও বিপদে আছি।’
পুনট হিমাগারের ব্যবস্থাপক বিপ্লব কুমার বলেন, ‘এবার আলু ক্রয়-বিক্রয়ের চিত্র উল্টো। দাম না থাকায় কৃষকরা হিমাগারে আলু নিতে আসছেন না। ব্যবসায়ীরা বেকার সময় কাটাচ্ছেন। গত বছর এ সময়ে মজুতের অর্ধেকেরও বেশি আলু হিমাগার থেকে বের হয়েছে। অথচ এবার একই সময়ে আলু বের হয়েছে মজুতের ৭ থেকে ৮ শতাংশ। আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে হিমাগার থেকে সম্পূর্ণ আলু বের হবে কি না, তা নিয়ে মালিকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।’
কৃষকদের ক্ষতির কথা স্বীকার করে জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, ‘বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। আশা করছি, কৃষক ও কৃষিকে বাঁচাতে সরকার অবশ্যই এ বিষয়ে সুদৃষ্টি দেবেন।’
জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক রাহেলা পারভিন বলেন, ‘জেলায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন আলুর চাহিদার বিপরীতে এবার উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৬৩ হাজার মেট্রিক টন। যার মধ্যে ২১টি হিমাগারে ২ লাখ ৬ হাজার মেট্রিক টন আলু মজুদ আছে। এ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৩ হাজার মেট্রিক টন। দাম না থাকায় হিমাগার থেকে আলু বিক্রি কম হচ্ছে।’