36601

08/18/2025 শরৎ যেন এক অম্লান কাব্য

শরৎ যেন এক অম্লান কাব্য

লাইফস্টাইল ডেস্ক

১৮ আগস্ট ২০২৫ ১১:২১

ঋতুচক্রের অবিরাম আবর্তনে প্রকৃতি প্রতিনিয়ত তার রূপ পরিবর্তন করে চলেছে। গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন ধরিত্রী রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে ওঠে, তখন বর্ষা তার শীতল ধারায় তাকে স্নান করিয়ে নতুন জীবন দান করে। তবে বর্ষার অবিরাম বর্ষণ কখনও কখনও বিষণ্ণতার ছায়া ফেলে যায়।

মেঘমেদুর দিনের অবসান ঘটিয়ে, প্রকৃতির সমস্ত মলিনতা ও কালিমা মুছে দিয়ে এক নতুন স্নিগ্ধতা আর প্রশান্তির বার্তা নিয়ে আগমন করে শরৎ। শরৎ যেন এক অম্লান কাব্য, যার প্রতিটি ছত্রে মিশে আছে নির্মলতা, শুভ্রতা আর অনাবিল আনন্দ। বর্ষার শেষে, যখন আকাশ থেকে কালো মেঘের দল বিদায় নেয়, তখন এক ঝলমলে নীল আকাশ আমাদের স্বাগত জানায়।

এই নীল ক্যানভাসে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। শরৎ মানেই এই মেঘ-রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা। কখনো মনে হয়, কোনো এক শিল্পী যেন মনের মাধুরী মিশিয়ে আকাশের গায়ে এঁকে দিয়েছে শুভ্রতার প্রতিচ্ছবি। এই মেঘগুলো কখনো ধারণ করে দূর পাহাড়ের অবয়ব, আবার কখনো মনে হয় যেন কোনো শিশু তার খেলার ঝুড়ি থেকে ছড়িয়ে দিয়েছে রাশি রাশি শিমুল তুলা।

রোদের সোনালি আলো যখন এই মেঘের ওপর পড়ে, তখন তা এক অপার্থিব দৃশ্যের জন্ম দেয়। মনে হয়, যেন স্বর্গের কোনো উদ্যান থেকে ভেসে আসা পারিজাতের দল। এই মেঘেদের ভেসে যাওয়া দেখতে দেখতে মন হারিয়ে যায় কোনো এক অজানা কল্পনার রাজ্যে। দিগন্তজুড়ে বিস্তৃত এই সাদা মেঘের চাদর দেখে মনে হয়, আকাশ আর পৃথিবী যেন এক পবিত্র ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। এই সময়ে বাতাসের আর্দ্রতা কমে আসে, প্রকৃতিতে এক ধরনের শুষ্কতা থাকলেও তা রুক্ষ নয়, বরং স্নিগ্ধ ও কোমল।

ভোরের বাতাসে মিশে থাকে এক দারুণ সজীবতা, যা শরীর ও মনকে মুহূর্তেই সতেজ করে তোলে। শরৎ আসে প্রকৃতির পুনর্জন্মের বার্তা নিয়ে। বর্ষায় ধুয়ে যাওয়া বৃক্ষলতা যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। গাছের পাতাগুলো হয়ে ওঠে আরও সবুজ, আরও উজ্জ্বল। চারদিকে প্রাণের এই প্রাচুর্য এক অনাবিল শান্তির অনুভূতি জাগায়। শরৎ যেন আমাদের শেখায়, জীবনের সব অবসাদ ও বিষণ্ণতাকে পেছনে ফেলে কীভাবে নতুন করে শুরু করতে হয়, কীভাবে নির্মল আনন্দে বেঁচে থাকতে হয়।

শরতের পুষ্প সম্ভার ও তার কাব্যিকতা

মেঘের সৌন্দর্যের জন্যই অনন্য নয়, এর পুষ্প সম্ভারও প্রকৃতিকে এক ভিন্ন মাত্রা দান করে। শরতের কথা মনে হলেই যে দুটি ফুলের ছবি আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে, তা হলো শিউলি আর কাশফুল। ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে শিউলির মিষ্টি সুবাস এক স্বর্গীয় আবেশ তৈরি করে। বিশেষ করে, প্রভাতে যখন মসজিদের মিনার থেকে ফজরের আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসে, তখন গাছের নিচে সবুজ ঘাসের ওপর টুপটাপ ঝরে পড়া শিশিরভেজা শিউলি ফুল এক পবিত্রতার অনুভূতি জাগায়।

এই দৃশ্য মনকে প্রশান্ত আত্মাকে শুদ্ধ করে। শিউলির এই ক্ষণস্থায়ী জীবন আর তার বিলিয়ে দেওয়া সৌরভ কবি ও সাহিত্যিকদের মনেও গভীর ছাপ ফেলেছে। একে নিয়ে রচিত হয়েছে অগণিত গান, কবিতা আর গল্প। কাজী নজরুল ইসলাম তার লেখনীতে শিউলির সৌন্দর্য ও পবিত্রতাকে তুলে ধরেছেন।

শিউলির কমলা রঙের বোঁটা আর সাদা পাপড়ি যেন শুভ্রতার প্রতীক। অন্যদিকে, শরৎ মানেই নদীর ধারে, চরের বুকে কিংবা গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠে যখন মৃদুমন্দ বাতাসে কাশফুলের সাদা মঞ্জরি দুলতে থাকে, তখন এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। মনে হয়, প্রকৃতি যেন তার সাদা আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে দিগন্তজুড়ে।

সূর্যের আলোয় এই কাশবন যখন চিকচিক করে, তখন তাকে রূপালি ঢেউয়ের সমুদ্র বলে ভ্রম হয়। নাগরিক জীবনের কোলাহল আর ব্যস্ততা থেকে দূরে, এই কাশফুলের রাজ্যে হারিয়ে যেতে কার না মন চায়! এই দৃশ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় গ্রামের সেই শান্ত, নিরিবিলি জীবনের কথা, যেখানে প্রকৃতি আর মানুষ একে অপরের সাথে একাত্ম হয়ে বাস করে।

কাশফুলের এই অপার সৌন্দর্য আমাদেরকে জীবনের সরলতা আর স্বাভাবিকতার দিকে আকর্ষণ করে। এটি মহান আল্লাহর এক নেয়ামত, যা তিনি প্রকৃতির মাধ্যমে আমাদের উপহার দিয়েছেন। শিউলি আর কাশের পাশাপাশি এ সময় আরও নানা ধরনের ফুল ফোটে, যেমন- পদ্ম, শালুক, বকুল। বিল ও ঝিলগুলো ভরে ওঠে পদ্ম আর শালুকের সৌন্দর্যে, যা শরতের প্রকৃতিকে করে তোলে আরও বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয়।

সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রায় শরতের প্রভাব

শরৎ কেবল প্রকৃতির রূপ বদলায় না, এটি জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতিতেও এক গভীর প্রভাব ফেলে। এই ঋতু নিয়ে আসে উৎসবের আমেজ। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা এই শরতেই অনুষ্ঠিত হয়। পূজা উপলক্ষে শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র এক আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ঢাকের বাদ্য, ধূপের গন্ধ, আর মানুষের কোলাহলে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। মণ্ডপে মণ্ডপে দেবী দুর্গার প্রতিমা স্থাপন এবং তাকে ঘিরে আরাধনা- এই সবকিছু মিলে এক আধ্যাত্মিক আবহ তৈরি হয়।

নতুন পোশাকে সজ্জিত হয়ে মানুষ একে অপরের বাড়িতে যায়, শুভেচ্ছা বিনিময় করে। এই উৎসবকে ঘিরে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে, যা গ্রামীণ সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। নাগরদোলা, পুতুলনাচ, আর নানা রকম লোকজ খেলাধুলার আয়োজন করা হয়। এই সময়ে আবহাওয়া থাকে অত্যন্ত মনোরম। নাতিশীতোষ্ণ এক পরিবেশ বিরাজ করে। দিনের বেলায় থাকে মিষ্টি রোদ আর রাতে হালকা শীতলতা।

এই আরামদায়ক আবহাওয়ার কারণে মানুষের মনেও এক ধরনের স্বস্তি কাজ করে। গ্রামের মেঠো পথে খালি পায়ে হাঁটতে গেলে যখন শরতের স্নিগ্ধ-শীতল বাতাস শরীর ছুঁয়ে যায়, তখন এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। চারপাশের সবুজ ফসলের খেত যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো চিত্র। সেই সবুজ ধানের শীষের ওপর দিয়ে যখন বাতাস বয়ে যায়, তখন যে ঢেউ খেলে যায়, তা এক জীবন্ত প্রাকৃতিক শিল্পকর্মের জন্ম দেয়।

নবজাগরণ ও জীবনের দর্শন

শরৎ কেবল প্রকৃতি ও উৎসবের ঋতু নয়, এটি আমাদের জন্য গভীর এক দার্শনিক বার্তাও বহন করে। শরৎ আমাদের শেখায় কীভাবে জীবনের সব কালিমা ও জীর্ণতাকে মুছে ফেলে নতুন করে পথচলা শুরু করতে হয়। গ্রীষ্মের প্রখরতা যেমন জীবনের কঠিন বাস্তবতা আর সংগ্রামের প্রতীক, তেমনি বর্ষার অবিরাম বারিধারা অনেক সময় বিষণ্ণতা আর স্থবিরতাকে নির্দেশ করে। এই দুই ঋতুর পর শরতের আগমন যেন এক নতুন ভোরের ইঙ্গিত দেয়।

এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জীবনের প্রতিটি কঠিন অধ্যায়ের পরেই সুন্দর ও শান্ত একটি সময়ের আগমন ঘটে। সাদা মেঘের ভেলা যেমন কোনো বন্ধন ছাড়াই ভেসে বেড়ায়, তেমনি আমাদেরও উচিত জীবনের সব ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হওয়া। শিউলি ফুলের জীবনকাল খুব সংক্ষিপ্ত হলেও, সে তার সুবাস দিয়ে চারপাশকে ভরিয়ে তোলে।

আমাদের স্বল্প জীবনে কতটুকু অন্যের জন্য বিলিয়ে দিতে পারলাম, সেটাই ভাবনার বিষয়। আমাদেরও উচিত অতীতের সব ব্যর্থতা ও গ্লানি ভুলে গিয়ে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা। এটি আমাদের আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ করে দেয়, আমাদের ভেতরের ইতিবাচক শক্তিকে জাগ্রত করে।

এই ঋতুর স্নিগ্ধতা আমাদের মনকে শান্ত করে, আমাদের চিন্তাভাবনাকে স্থির করে। এই স্থির ও শান্ত মনে আমরা জীবনের গভীর অর্থ খুঁজে পাই। আমরা বুঝতে পারি যে, সুখ আসলে কোনো বাহ্যিক বস্তুর মধ্যে নয়, বরং প্রকৃতির এই নির্মল সৌন্দর্যের মাঝে, জীবনের এই সরলতার মাঝেই লুকিয়ে আছে।

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]