স্বাধীনতার এত বছর পরেও বাংলাদেশের উন্নয়ন ভাবনা মূলত ঢাকাকে ঘিরেই। কত সরকার এলো-গেল, কিন্তু ঢাকার বাইরে সারা দেশে উন্নয়ন ছড়িয়ে দেওয়ার খুব একটা আগ্রহ দেখা গেল না সেভাবে। অথচ আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন বৈষম্য।
দেশ স্বাধীনের পর আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের উন্নয়ন হবে গোটা বাংলাদেশ জুড়ে। উত্তরের রংপুর থেকে দক্ষিণের বরিশাল; পূবের সিলেট থেকে পশ্চিমের রাজশাহী। সব এলাকাতেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নাগরিক সুবিধার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। কেন্দ্রের ঢাকা, রাজধানী ঢাকাতেই সবকিছু কেন্দ্রীভূত হবে না। অথচ আমাদের সব নজর এখনো ঢাকার দিকে।
ত্রিশ বছর আগেও সরকারি চাকরিজীবীরা পরিবার নিয়েই বিভিন্ন জেলায় অফিস করতেন। আমাদের জেলা শহরের স্কুলগুলোর খুব নামডাক ছিল। মফস্বলে জীবনের আলাদা একটা প্রাণ ছিল। ঢাকা তখনো রাজধানী। কিন্তু এখনকার মতো দানবীয় আকারে ঢাকা বড় হয়ে উঠেনি।
নব্বইয়ের দশকের পর থেকেই সরকারিভাবে অতি গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বেসরকারি খাত ধীরে ধীরে ঢাকায় বড় হতে থাকে। বিপরীতে চট্টগ্রাম বাদে অন্য বিভাগীয় শহর, জেলা শহরগুলো নিষ্প্রাণ হতে থাকে।
মুক্তিযুদ্ধের পরে বৈষম্যহীন সোনার বাংলা গড়বার ছিল ব্যাকুল আমাদের আকাঙ্ক্ষা। সংবিধানে ১৯(১) লেখা, ‘মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’।
অথচ আমাদের পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মাদারীপুর, ঝালকাঠি, পিরোজপুরসহ অনেক এলাকার দারিদ্র্য এখনো অনেক বেশি। ফলে রংপুর, রাজশাহী, বরিশাল, ময়মনসিংহসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দরিদ্র মানুষেরা এসে ভিড় করে ঢাকা শহরে। কাজের আশায়, খেয়ে পড়ে একটু বেঁচে থাকবার আশায়।
আমাদের কর্মসংস্থানের সুযোগগুলো কেন আমরা সেভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দিতে পারলাম না। সব কাজের সুযোগ যেন ভিড় করেছে ঢাকা, আর ঢাকার আশেপাশের দুই জেলা গাজীপুর আর নারায়ণগঞ্জে। মেগাসিটি ঢাকার পরিবেশ, প্রতিবেশ আর বাসযোগ্যতা ধ্বংস করে আমরা উন্নয়ন আর কর্মসংস্থানের এককেন্দ্রিক মডেল দাঁড় করিয়েছি। এই মডেল দেশের উন্নয়ন ভারসাম্যতা অস্থিতিশীল করে তুলেছে। এটা তাই টেকসই নয়।
আমরা চেয়েছিলাম শুধু নগর এলাকা নয়, গ্রামীণ এলাকার বিকাশেও রাষ্ট্র কাজ করবে। গ্রামীণ শেকড়ের সাথে আমাদের সংযোগ আরও সুদৃঢ় হবে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে।
সংবিধানের ১৬ ধারায় আমরা অঙ্গীকার করেছিলাম, ‘নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবন যাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা, কুটিরশিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ-ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’।
অথচ স্বাধীনতার এত বছর পরেও গ্রামীণ এলাকার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা হয়নি। গ্রাম থেকে মানুষ পঙ্গপালের মতো উন্নত শিক্ষা, চিকিৎসা আর কর্মসংস্থানের জন্য নগরে ছুটছেন। এদের অনেকেই আসছেন ঢাকায়। গ্রামের স্কুলে মানসম্মত শিক্ষক নেই, ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভালো ডাক্তার কিংবা চিকিৎসা সেবা নেই।
গ্রামে বিদ্যুৎ-এর লাইন থাকলেও সেখানে বিদ্যুৎ আসা যাওয়ার মধ্যেই থাকে। আর এদিকে ঢাকা শহরের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতেই রাষ্ট্রের সব মনোযোগ। মাত্রাতিরিক্ত এসির ব্যবহারসহ বিলাসী বিদ্যুৎ চাহিদা শহরের বড় বড় ভবন অট্টালিকায়। আমাদের সিংহভাগ বিদ্যুৎ ব্যয় হচ্ছে ঢাকায়।
একইভাবে, দেশের উন্নয়ন বাজেটের অনেকটাই ব্যয় হয় ঢাকায়। ইন্সটিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) এর ২০২৩ সালে প্রকাশিত 'বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের আঞ্চলিক বিন্যাস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায় ঢাকা জেলা দেশের মোট উন্নয়ন বরাদ্দের ২১ শতাংশ পাচ্ছে।
আঞ্চলিক বিবেচনায় বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চল পাচ্ছে শতকরা ৩২ ভাগ ও চট্টগ্রাম অঞ্চল পাচ্ছে ১৫ ভাগ। বিপরীতে সর্বনিম্ন বরাদ্দ পাচ্ছে বৃহত্তর কুষ্টিয়া (১.৫৩ ভাগ), পার্বত্য অঞ্চল (১.৬০), বৃহত্তর বগুড়া (১.৬৮) ও বৃহত্তর দিনাজপুর (১.৮০ ভাগ)। ফলে দেশের জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বাজেট বরাদ্দের মধ্যে ব্যাপক ভিন্নতা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
দেশের এডিপি প্রকল্পে সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত ৭টি জেলাই মোট বরাদ্দের ৫০ ভাগ বরাদ্দ পাচ্ছে, অথচ স্বল্প বরাদ্দপ্রাপ্ত ২৫টি জেলা পাচ্ছে মাত্র ১৩ ভাগ। ফলে দেশের উন্নয়নে ঢাকাকেন্দ্রিকতা স্পষ্ট, তেমনি দৃশ্যমান উন্নয়ন এর আঞ্চলিক বৈষম্য।
মেট্রোরেল, পাতাল রেল, এক্সপ্রেসওয়ের মতো প্রকল্প ঢাকাকেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেলের দৃশ্যমান বাস্তবতা। অথচ দেশের সব বিভাগীয় শহর ও আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোর সাথে দ্রুতগতির রেল যোগাযোগ আমরা এখনো সেভাবে স্থাপন করতে পারিনি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় শ’খানেক অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বিগত সময়ে। এই উদ্যোগকে কার্যকর করার জন্য সঠিক পরিকল্পনা করা দরকার। কিন্তু বিস্ময়কর সত্য হচ্ছে, এই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর বেশিরভাগ ঢাকা ও তার আশেপাশের এলাকায় অবস্থিত।
যেকোনো দেশের উন্নয়ন শুধু একটি এলাকা বা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে টেকসই ও স্থায়িত্বশীল হতে পারে না। বেইজিং-এর পাশাপাশি চীন উন্নয়নের আলো ফেলেছে সাংহাই, গুয়াংজো, চংকিংতে। ভারতের দিল্লি ছাড়াও মুম্বাই, চেন্নাই, কলকাতা, বাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ এলাকাগুলোয় উন্নয়নের বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে।
জার্মানির রাজধানী বার্লিনের সাথে উন্নত শহর আছে মিউনিখ, স্টুটগার্ট, ফ্রাঙ্কফুর্ট, কোলন প্রভৃতি। ঠিক তেমনি দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী আছে তিনটি; প্রিটোরিয়া, কেপটাউন, ব্লুমফন্টেইন। বাংলাদেশের সময় এসেছে দেশের উন্নয়নকে ঢাকার মধ্যে আবদ্ধ না রেখে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার।
বাংলাদেশের মানুষ কাজের সন্ধানে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যায়। যায় সুদূর আফ্রিকা কিংবা আমেরিকাতেও। ফলে উপযুক্ত কাজের সুযোগ তৈরি করতে পারলে মানুষ দেশের যেকোনো অঞ্চলে যাবে।
নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেড বিকেন্দ্রীকরণের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ এটি রংপুর বিভাগের মতো উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং বেকারত্ব কমিয়ে এনেছে। উত্তরা ইপিজেডকে কেন্দ্র করে শুধু শিল্পই গড়ে ওঠেনি, এর সাথে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন সেবা খাতেরও বিকাশ ঘটেছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের জন্য একটি মডেল হতে পারে এটি।
দেশের উন্নয়নে ঢাকাকেন্দ্রিক মানসিকতা থেকে আমাদের সরে আসতে হবেই। এর অন্য কোনো বিকল্প নেই। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তেই আমাদের জুলাই-এর গণ অভ্যুত্থান হয়েছে। বিস্ময়করভাবে নতুন বাংলাদেশের সংস্কার আলাপে সমগ্র দেশের সুষম উন্নয়ন এর আলাপ যথাযথ গুরুত্ব পায়নি।
ঢাকাই বাংলাদেশ নয়, বাংলার জমিন অনেক বড়। উন্নয়নের সুফল সব প্রান্তরে পৌঁছাতে হবে আমাদের। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সারা দেশের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা করার এখনই সময়।
ড. আদিল মুহাম্মদ খান : অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)