40150

10/27/2025 টিআরপি ও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের বাজার

টিআরপি ও টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের বাজার

আদিত্য আরাফাত

২৭ অক্টোবর ২০২৫ ১২:১৩

টেলিভিশনে কোন চ্যানেল মানুষ বেশি দেখে বা কম দেখে তা নিরূপণ করার যে সিস্টেম তা হচ্ছে টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট। টেলিভিশন দর্শক পরিমাপের এ পদ্ধতিকে সংক্ষেপে টিআরপি বলা হয়। এর মাধ্যমে চ্যানেলের রেটিং পয়েন্টের পাশাপাশি কোন প্রোগ্রাম মানুষ বেশি দেখে বা কম দেখে তারও তালিকা করা হয়।

বৈশ্বিকভাবে টিআরপির তালিকা হয় না। বেশিরভাগ দেশেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের স্বার্থে এই কাজ করে থাকে। বেসরকারি বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো দর্শক সংখ্যা। এই টিআরপি তালিকা দেখে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থা, এজেন্সি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রে টিআরপি করা হয় ‘নিলসেন মিডিয়া রিসার্চ [Nielsen Media Research (NMR)]’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যারা অন্তত ২০ হাজার পরিবারের টিভিতে ইলেকট্রনিক মিটার বসিয়েছে। প্রতিটি পরিবারের সদস্যের জন্য আলাদা কোড রয়েছে—যাতে বোঝা যায় কে টেলিভিশন দেখছে, দেখলে কোন চ্যানেল দেখছে।

সেই ডেটা যথাসময়ে নিলসেন-এর সার্ভারে চলে যায়। যারা মাধ্যমে টিআরপি নির্ধারিত হয়। যুক্তরাজ্যে ‘‌ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ বোর্ড [Broadcast Audience Research Board (Barb)]’ নামক একটা স্বাধীন সংস্থা টিআরপি সংগ্রহ করে থাকে। ১০ হাজার পরিবার থেকে তারা টেলিভিশনর ডেটা সংগ্রহ করে। ভারতে ইন্ডিয়ান টেলিভিশন অডিয়েন্স মেজারমেন্ট [Television Audience Measurement] নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৬০ থেকে ৭০ হাজার পরিবার থেকে স্যাম্পল নিয়ে টিআরপি নির্ধারণ করে থাকে।

বাংলাদেশে আগে ‘কান্তার মিডিয়া [Kantar Media]’ নামক বেসরকারি সংস্থা টিআরপি সংগ্রহ করত। এসব প্রতিষ্ঠানের টিআরপি পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। বলা হয়েছে, কয়েকটি চ্যানেল টিআরপি কারসাজি করে বিজ্ঞাপনের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এমন অভিযোগের মুখে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) [Bangladesh Satellite Company Limited (BSCL)]’ টিআরপি সেবা দিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব দেয়। মন্ত্রণালয় নীতিগতভাবে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করে এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি মধ্যে কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দেয়।

৪ জানুয়ারি ২০২৩ জারি করা এক নির্দেশনায় ন্যূনতম ৫০০টি সেট-টপ বক্স স্থাপনের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরুর শর্ত দেওয়া হয়। পরে ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ আরেকটি নির্দেশনায় বলা হয়, বিএসসিএল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে টেলিভিশন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করবে।

চুক্তি স্বাক্ষরের দুই মাসের মধ্যে তাদের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। সেখানে বলা হয়, শুরুতে ন্যূনতম দুই হাজার ডিভাইস বা সেট-টপ বক্স দিয়ে কাজ শুরু করতে হবে এবং ছয় মাসের মধ্যে এর সংখ্যা আট হাজারে উন্নীত করতে হবে।

রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানের অধীনে টিআরপি সংগ্রহ করা হলেও কারসাজির অভিযোগ এসেছে ৮ মার্চ ২০২৫ গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পেশ করা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে পদ্ধতিতে এখন টিআরপি সংগ্রহ করা হচ্ছে তা ভৌতিক। ন্যূনতম দুই হাজার সেট-টপ বক্স দিয়ে টিআরপি সেবার কাজ শুরুর কথা ছিল, কিন্তু বিএসসিএল সেই সেবা দিচ্ছে ৩০০ ডিভাইস দিয়ে।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বিএসসিএল তখন পর্যন্ত মাত্র ২০০টি সেট-টপ বক্স দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। ২০২৫ সালের মার্চে সেট-টপ বক্সের সংখ্যা ৩০০ করা হয়।

কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, নিম্নমানের ও অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে যেভাবে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে, তার জন্য সেই টেলিভিশন চ্যানেলদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।

এই ‘ত্রুটিপূর্ণ’ টিআরপি ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য টেলিভিশন চ্যানেল ও বিজ্ঞাপন শিল্পের প্রতিনিধিদের কার্যকর উপায় নির্ধারণ করা জরুরি বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়।

গণমাধ্যম কমিশনের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ঢাকাসহ সারাদেশে টিআরপি ডিভাইস মাত্র ৩০০টি। এসব ডিভাইস দিয়ে দেশের মানুষ কোন টেলিভিশন বেশি দেখছে বা কম দেখছে তার প্রতিবেদনও দেওয়া হয়। আর রিপোর্টের আলোকে ঠিক হয় বিজ্ঞাপনের বাজার।

যেভাবে টিআরপি কারসাজি হয়:

ধরা যাক, দেশে টিআরপি ডিভাইস বা সেট-টপ বক্স চারশোটি। সিন্ডিকেট মাত্র ৪০টা ডিভাইসে কারসাজি করে যেকোনো চ্যানেলকে শীর্ষে নিয়ে আসতে পারে। এর ফলে যে চ্যানেলের বাস্তবে মাত্র ১০ শতাংশ দর্শক, এই কারচুপিতে তার বাজারের দখল বেড়ে ৮০ শতাংশের বেশি হয়ে যায়। এর চেয়ে কম অর্থাৎ মাত্র ১০টি টিআরপি ডিভাইস আয়ত্তে নিয়েও রেটিং পয়েন্ট অনেক উপরে নিয়ে যেতে পারে।

যে চ্যানেলের টিআরপি বেশি সে চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের রেটও স্বভাবত বেশি। বিজ্ঞাপনী সংস্থা বা বিজ্ঞাপনদাতা বা এজেন্সি প্রতিষ্ঠানগুলো টিআরপির তালিকা দেখেই বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। মূলত টিআরপির তালিকা ধরেই ঠিক হয় টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের বাজার।

দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে টিআরপি পদ্ধতি থাকলেও এ খাত নিয়ে কোনো মনিটরিং ছিল না। কেউ কারসাজি করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হয়নি। তা নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণাও নেই।

ভারতে টিআরপি নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ যেমন ওঠে আবার তার তদন্তও চলে। ২০২০ সালের ২৪ ডিসেম্বর টিআরপি জালিয়াতি মামলার অভিযুক্ত হিসেবে ‘ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল [Broadcast Audience Research Council]’ এর সাবেক সিইও পার্থ দাশগুপ্তকে মুম্বাই থেকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয় (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০)।

বাংলাদেশে দুই দশকে টিআরপি জালিয়াতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত চ্যানেলগুলোর আর্থিক ক্ষতি কী পরিমাণ তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে আন্দাজ করা যায় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

বাংলাদেশে এখন টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের বাজার কত তার একটি ধারণা পাওয়া যায়, বেসরকারি আর্কাইভস সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘রায়ান আর্কাইভস লিমিটেড [Ryans Archives Ltd]’-এর জরিপে।

২০২৩ সালে ৩৬টি টেলিভিশন চ্যানেলের ওপর জরিপ চালিয়ে রায়ান আর্কাইভস মোট ৮৬৪ জন বিজ্ঞাপনদাতাকে শনাক্ত করে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় এ বিজ্ঞাপনদাতারা সব মিলিয়ে বিজ্ঞাপন দেন ১ কোটি ৬ লাখ ৯১ হাজারটি। এর বাজারমূল্য ৫ হাজার ১৬৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ সব মিলিয়ে প্রিন্ট ও টেলিভিশনে ২০২৩ সালে দেওয়া বিজ্ঞাপনের বাজারমূল্য প্রায় ৭ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। [সময় টেলিভিশন, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪]

টেলিভিশনে যেসব অ্যাড এজেন্সি বা বিজ্ঞাপনদাতা বিজ্ঞাপন দেয় তা মূলত টিআরপি তালিকা দেখেই দিয়ে থাকে। তালিকা অনুযায়ী নিজেদের বিজ্ঞাপনের রেট ঠিক করে চ্যানেলগুলো। বছরের পর বছর টিআরপি যে তথ্য দেয়, তাতে দেখা যায়, বাস্তবে যে চ্যানেল মানুষ বেশি দেখছে বলা হয়, টিআরপিতে ওই চ্যানেলকে তলানিতে দেখা যায়। ফলে পেশাদারিত্ব রেখে যেসব চ্যানেল পরিচালিত হয়েছে বা হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠ টিআরপি পদ্ধতি না থাকায় সেসব চ্যানেলের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে তুলনামূলক অল্প বাজেটের চ্যানেল কারসাজি করে তালিকায় উপরে থাকতে পেরেছে।

বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এখন দেশে টিআরপি সংগ্রহ করছে। এ প্রতিষ্ঠানটি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে। মন্ত্রণালয়ের উচিত, বিএসসিএল-এর টিআরপি সিস্টেমকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় আনা।

সেই সঙ্গে গ্রহণযোগ্য টিআরপি’র জন্য গ্রামে শহরে মিলে সেট-টপ বক্স অন্তত ১০ হাজার করা। এতে কোন চ্যানেল দর্শকরা বেশি দেখছি আর কোন চ্যানেল কম দেখছে তার সঠিক চিত্র ওঠে আসবে। অবশ্য এসব বক্স যদি কোনো পক্ষ নিজেদের মতো পরিচালনা করে তাতে আবারও সেই পুরোনো কলে আমাদের পড়তে হবে। তাই টেলিভিশন বিজ্ঞানপনের স্বার্থে টিআরপি-এর সঠিক ডাটা জানা এবং জানানো জরুরি।

আদিত্য আরাফাত : অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর, ডিবিসি নিউজ

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]