40627

11/16/2025 শিশুর মনন গঠনে বিভিন্ন দেশে কী পড়ানো হয়?

শিশুর মনন গঠনে বিভিন্ন দেশে কী পড়ানো হয়?

ড. আরিফ হায়দার

১৬ নভেম্বর ২০২৫ ১০:০১

জীবনের চলমান রীতির শৈল্পিক বিন্যাস হয়ে ওঠে সংস্কৃতির আধার। জীবনের বাস্তবতার অভিজ্ঞতা ক্রমান্বয়ে অনুশীলনের ফলে শৈল্পিক রূপ নেয় সাংস্কৃতিক প্রয়োগে। সামাজিক ব্যাধি স্ব-মূলে উৎপাটন করতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বৃহৎ কাঠামো রূপে কাজ করে।

সমাজের দ্বান্দ্বিকতার অবসান ঘটায় সাংস্কৃতিক কর্মীর উদ্ভাবনী শক্তি। পরবর্তীতে চিন্তাচেতনার শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের ওপর সুন্দর ফলস্বরূপ হয়ে উপস্থাপিত হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আধুনিকতার শীর্ষ দেশে এসে দেখা গেল একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ছাড়াও শিশুদের চিন্তাচেতনাকে গুরুত্ব দিয়ে সংস্কৃতিচর্চা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

একজন শিশুর সমাজকে দেখবার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন সে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। উন্মুক্ত আকাশ, খোলা মাঠ, নদীতে মানুষ প্রাণ ভরে শ্বাস নেয়, ঠিক তেমনি শিশুদের মনে যেন সমাজকে বদলে দেওয়ার প্রত্যয় জাগে। আর তাই সমাজকে ভেঙে গড়ার লক্ষ্যে তৈরি হয় প্রতিবাদী গান, নাটক, কবিতা, চিত্রাঙ্কন, নৃত্য ইত্যাদি।

বিশ্বের মন ও মননে সংস্কৃতিচর্চায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মও অগ্রদূত হতে পারে সব শিশু। শিশুদের নিয়ে পৃথিবীর সব স্বাধীন রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন সামাজিক চেতনামূলক সংগঠনগুলো কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেরকম একটি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা যেতেই পারে সেভ দ্য চিলড্রেন (ইউ.কে)।

এটি মূলত একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ তাদের স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত জীবনের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। এ রকম শত শত প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে পৃথিবীর বুকে। আমরা জানি একটি স্বাধীন দেশ সুন্দরভাবে গড়তে আগামী প্রজন্মদের নতুন সূর্যের আলো দেখাতে হয়। আর সেই আলোর মানুষ গড়ে তোলে পৃথিবীর প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুন্দর মনের শিক্ষকরা।

প্রথমে রাষ্ট্র নির্ধারণ করে দেয় তার দেশের শিশুরা কীভাবে ভূষিত হবে। তার মন মানসিকতা কীভাবে গড়ে উঠবে। আর তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের শিশুদের জন্য উপযুক্ত পাঠ্যক্রম তৈরি করে। এখানে কয়েকটি দেশের পাঠক্রম নিয়ে আলোচনা করা হলো—

জাপান: জাপানের শিশুশিক্ষার পাঠ্যক্রমে রাখা হয়েছে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা, নৈতিকতা ও আচরণের ওপর শিক্ষা। প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে ৯ বছর বয়সের মধ্যে বাধ্যতামূলক শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়।

এই সময় তাদের জাপানি ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, সামাজিক অধ্যয়ন, সংগীত, শিল্পকলা এবং শারীরিক শিক্ষার মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষাদান করা হয়। এছাড়াও শিশুদের স্কুলের আঙিনা পরিষ্কারসহ একে অপরকে সম্মান করা এবং সহানুভূতিশীল হতে শেখানো হয়ে থাকে। এমন পাঠ্যক্রমের মধ্য দিয়ে জাপানের শিশুরা বেড়ে ওঠে তাদের সমাজে।

চীন: চীনের শিশু পাঠ্যক্রম একটি ছয়-স্তরীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ, যেখানে ৬ বছর বয়সে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুরু করা হয়। এই শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে শিশুকে পড়তে হয় তার নিজের ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা।

চীনে শারীরিক শিক্ষার ওপর বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়। কারণ ছোটবেলা থেকে নিজের শরীর সম্পর্কে জানতে পারলে, তার পথ, চলার গতি ছন্দময় হয়ে উঠবে বলে তারা মনে করে। এমনকি চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বয়সের শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশের ওপর ভিত্তি করে নানা প্রয়োজনীয় কর্মসূচি তৈরি করে।

এছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শিক্ষার জন্য সম্প্রতি ৬ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েদের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে AI শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কারণ জীবন চলার পথে যেন তাদের থেমে থাকতে না হয়।

সৌদি আরব: সৌদি আরবের শিশু পাঠ্যক্রমের মূল বিষয় আরবি, ইসলাম শিক্ষা, গণিত ও বিজ্ঞান। সেখানে প্রাথমিক শিক্ষা ৬ বছর থেকে ১২ বছর বয়স পর্যন্ত বাধ্যতামূলক এবং ইংরেজিও অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে মেয়েদের জন্য গার্হস্থ্য অর্থনীতি এবং ছেলেদের জন্য শারীরিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত।

যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদের পাঠ্যক্রম সাধারণত সেই দেশের সাধারণ মূল রাষ্ট্রীয় মানদণ্ড (Common Core State Standards)-এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। এই পাঠ্যক্রমের মধ্যে ইংরেজি, কলা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল এবং বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত।

তবে কিছু রাজ্যভেদে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। কিন্তু সব রাজ্যেই সংগীত, চিত্রকলা ও শারীরিক শিক্ষা শেখানো হয়। এমনকি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা, প্রয়োজন অনুসারে স্বতন্ত্র শিক্ষা কার্যক্রম (Individualized Education Program- IEP) পরিচালনা করা হয়ে থাকে।

একটা জাতির মেরুদণ্ড আগামী প্রজন্ম। তাইতো প্রতিটি রাষ্ট্র কাঠামোতে শিশুদের গড়ে তোলার জন্য বেসিক যা যা প্রয়োজন তা করা হয়। এমনকি কখনো কখনো দেখা যায় রাষ্ট্রপ্রধান শিশুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিশুদের সাথে সময় কাটিয়ে থাকেন। জাতির ভবিষ্যৎদের গড়ে তোলার জন্য এমনই তো হওয়া উচিত।

সারা বিশ্বে শিশুদের প্রতি দেওয়া হয় বিশেষ দৃষ্টি। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই রয়েছে শিশুর চিন্তা বিকাশের ধারা, সেখানে অভাব নেই। নিয়ন্ত্রিত আইন, উপস্থাপনার জন্য জায়গার অভাব, সামাজিক ও রাজনৈতিক বাধা বা অন্য কোনো সমস্যা নেই। উপরন্তু রয়েছে বড়দের একনিষ্ঠ অনুপ্রেরণা, সুযোগ সৃষ্টি, অসংখ্য আধুনিক মঞ্চ, অর্থ বরাদ্দ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ।

শিশুদের জন্য সৃষ্টি করা হয় এক বিশেষ পরিবেশ। যেখানে শিশুরা সহ-প্রতিভায় বেড়ে উঠছে বিনা বাধায়। আমরা শিশুদের জন্য কী করছি একবারে ভেবে দেখেছি কি?

নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা মানুষকে হাঁটা শেখায়, কথা বলতে শেখায়, কাপড় পরতে শেখায়, খেতে শেখায়, ভালবাসতে শেখায়, সব সমস্যার মোকাবিলা করতে শেখায়, নিজেকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে শেখায়, জীবনকে জানতে শেখায়, মুক্ত বুদ্ধি সম্পন্ন হতে শেখায়, পরমত সহিংসতা শেখায়, সত্য জানতে শেখায়, সর্বোপরি সেসব দিক থেকে নিজেকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে যদি তার সততা ও নিষ্ঠা থাকে।

তবে আমার কথা হলো আমাদের শিশুরা জন্মগতভাবেই কিছু প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। এটা আমাদের বাংলা মায়ের মাটির রস, আলো, বাতাস থেকে পাওয়া সংগীত-নৃত্য-নাটক থেকে তাদের অস্থি এবং মজ্জায়।

মা যখন শিশুকালে ঘুমপাড়ানিয়া গান গেয়ে ঘুম পাড়াতো ঠিক তখন থেকেই তো অস্থিমজ্জায় মিশে আছে সুর। এমন শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড।

ড. আরিফ হায়দার : অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]