41404

12/03/2025 প্রতিবন্ধিতা ও সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

প্রতিবন্ধিতা ও সম্ভাবনার নতুন দুয়ার

ডা. লেলিন চৌধুরী

৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৮:০৫

আইনস্টাইনের পরে যে বিজ্ঞানী আমাদের সময়ে বিশ্বকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করছেন তিনি হলেন স্টিফেন হকিং। মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব এবং মহাজাগতিক ঘটনাবলীর ব্যাখ্যায় হকিং এখনো অগ্রণী বিজ্ঞানী। একুশ বছর বয়সে তিনি দুরারোগ্য মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হন।

ধীরে ধীরে তার শরীরের প্রায় সবটুকু অবশ বা প্যারালাসিস হয়ে যায়। তিনি পঙ্গু ও বাকহীন হয়ে পড়েন। কিন্তু শারীরিক সব অসামর্থ্যকে অতিক্রম করে নিজেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, মহাকাশ বিজ্ঞানী, লেখক এবং শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলেন।

প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। শারীরিক সামর্থ্যহীনতা সেই সম্ভাবনার বিকাশে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না। তবে সেজন্য একটি সহায়ক পরিবেশ, সঠিক শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির প্রয়োজন হয়।

প্রতিবন্ধী বলতে আমরা কি বুঝি? প্রতিবন্ধী বলতে আমরা সেইসব মানুষকে বুঝি যারা রোগ, দুর্ঘটনা, আঘাত বা অন্য কোনো কারণে শারীরিক বা মানসিক অথবা উভয়ভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে স্থায়ী কর্মক্ষমতাহীন ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম হয় যায়। এই অক্ষমতা বা অসামর্থ্য শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, শ্রবণ, বাক, অটিজম এবং অন্যান্য ধরনের হতে পারে।

শরীরের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে অক্ষম ব্যক্তিকে শারীরিক প্রতিবন্ধী বলা হয়যে মানুষ মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না তাকে মানসিক প্রতিবন্ধী বলা হয়

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর দৃষ্টি ক্ষমতা আংশিক বা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকেএজন্য সে সমাজের আর দশটা মানুষের মতো যাবতীয় কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়এভাবেই শ্রবণবাক প্রতিবন্ধীর শোনার এবং কথা বলার আংশিক বা পূর্ণ অসামর্থ্য থাকে

তবে অটিজম হচ্ছে মানুষের বিকাশমূলক প্রতিবন্ধিতা যার কারণে একজন ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ এবং স্বাভাবিক আচরণে অসমর্থ হয়। প্রতিবন্ধিতা শুধু একটি ক্ষেত্রে (যেমন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী) হতে পারে। আবার সেটা যৌগিক ধরনের অর্থাৎ একের অধিক প্রতিবন্ধিতা একসাথে হতে পারে।

যেমন বিখ্যাত লেখক এবং মানবতাবাদী হেলেন কেলার একইসাথে অন্ধ এবং বধির ছিলেন। আমাদের চারপাশে বহু মানুষ আছেন যারা একসাথে চার, পাঁচ বা ছয় ধরনের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে জীবনযাপন করছেন।

বহু বছর ধরে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীদের দেশ এবং সমাজের বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অনেক সমাজে প্রতিবন্ধিতাকে পাপের ফল, অভিশাপের ফল, ওপরওয়ালার শাস্তি, ভূত-প্রেতের কু-নজর,খারাপ বাতাস লাগা, চোখ লাগা, বান মারা, জিনে ধরা, তাবিজ করা ইত্যাদি নানা ধরনের কুসংস্কার দ্বারা ব্যাখ্যা করা হতো।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হতো। ক্ষেত্র-বিশেষে প্রতিবন্ধী শিশু, বৃদ্ধ বা ব্যক্তিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার উদাহরণও রয়েছে। অবশ্য প্রচলিত কুসংস্কারের সাথে দারিদ্র্যের সহযোগ ঘটলে নিষ্ঠুরতার ঘটনা বেশি ঘটে।

জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতি, প্রযুক্তির উন্নয়ন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিকাশ, মানুষের অধিকার বিষয়ক বোধের বিস্তার ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পেরেছি প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। এছাড়া বিশ্ববাসীর চোখের সামনে স্টিফেন হকিং, হেলেন কেলারসহ শত শত কৃতি মানুষের উদাহরণ জ্বল জ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে।

প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। তদ্রূপ প্রতিবন্ধীদের মধ্যেও আছে অমিত সম্ভাবনার আকর। সঠিক, কার্যকর শিক্ষা ও যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা সম্ভব।

এজন্য একদিকে দরকার শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ ও লাগসই প্রযুক্তির সহায়তা, অন্যদিকে প্রয়োজন প্রতিবন্ধীদের জন্য কর্ম সহায়ক পরিবেশ, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং চারপাশের মানুষের সহযোগিতার মনোভাব। মূলত এই কাজটি করার জন্য ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রতি বছরের ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালন করা হয়।

জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘সমাজ ও উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার, কল্যাণ ও সুযোগ নিশ্চিত করা এবং তাদের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।’

প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সামনে কতোগুলো চ্যালেঞ্জ থাকেসমাজউন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি। ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জন্য সমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুযোগ তৈরি করা দরকার।

সর্বক্ষেত্রে তাদের জন্য সমান সুযোগবিশিষ্ট সহযোগিতাসহমর্মিতার বলয়ে ঘেরা সামাজিকসামগ্রিক পরিবেশ তৈরির জন্য সবাইকে যার যার জায়গা থেকে কাজ করতে হবেআমরা এমন একটি সভ্য টেকসই মানবিক সমাজ তৈরি করতে চাই যেখানে প্রত্যেক মানুষের অধিগম্যতা থাকবে, মানুষ মানুষকে সম্মান করবে, ন্যায্যতাভিত্তিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবেআমরা সবাই মিলে একত্রে সামনে এগিয়ে যাবো, কেউ পেছনে পড়ে থাকবে নাএজন্য দেশের সরকার এবং সাধারণ নাগরিক এই উভয়পক্ষকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে

১৯৯২ সালে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস উদযাপন শুরু হয়। ১৯৯৯ সাল থেকে একই দিন অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস পালন করা শুরু করে। তাই ২০২৫ সাল হচ্ছে ৩৪তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস এবং ২৭তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস উদযাপন।

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিবন্ধী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে—‘প্রতিবন্ধিতা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ি, সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করি।’

প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সুরক্ষা, তাদের কল্যাণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০০৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘প্রতিবন্ধী অধিকার সনদ’ অনুমোদন করে। এই সনদের আলোকে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করে।

এই আইনের ৩১(১) ধারা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিবন্ধন এবং পরিচয়পত্র প্রদানের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এখনো পর্যন্ত দেশের সব প্রতিবন্ধী মানুষকে নিবন্ধনের আওতায় আনা যায়নি। এজন্য বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।

আমরা মনে করি তথ্যগত বিভ্রান্তির অবসান করা আশু প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকার নিবন্ধিত প্রতিবন্ধীদের ভাতা প্রদানের শুরু করে ২০০৫-০৬ সালে। আগে এই ভাতার পরিমাণ ছিল মাসিক ৬০০ টাকা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ভাতার পরিমাণ মাসে ৭৫০ টাকা করা হয়।

জীবনযাত্রার ব্যয় অনুযায়ী এই অর্থের পরিমাণ নিতান্তই নগণ্য। আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মশক্তিতে রূপান্তর করা হবে। কেবলমাত্র যারা পুরোপুরি সামর্থ্যহীন তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা বলয়ে আনা হোক।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে তা একেবারে অপ্রতুল এবং অপর্যাপ্ত। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই জনগোষ্ঠীর জন্য ‘পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা’ গড়ে তোলা হোক।

দেশের নীতিনির্ধারকগণ এবং সাধারণ নাগরিকবৃন্দ যৌথভাবে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীদের ‘বোঝা নয় সম্পদে পরিণত করা’-এর লক্ষ্যে অগ্রসর হই তাহলে কাউকে পেছনে না ফেলে সবাই একত্রে মানবিকতার পথে মাথা উঁচু করে অগ্রসর হতে পারবো।

সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী
যোগাযোগ: রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল: [email protected], [email protected]