রবিবার, ১৫ই জুন ২০২৫, ৩১শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২


বাজারে উঠেছে হাঁড়িভাঙা আম, কেনাবেচা ২০০ কোটি ছাড়বে


প্রকাশিত:
১৪ জুন ২০২৫ ১১:০২

আপডেট:
১৫ জুন ২০২৫ ০২:০৩

ছবি সংগৃহীত

রংপুরের জিআই পণ্যখ্যাত ‘হাঁড়িভাঙা’ আম বাজারে আসতে শুরু করেছে। প্রতি বছর এই আম জুনের ২০ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে বাজারজাত শুরু হলেও এবার তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে গাছ থেকে আগাম আম পাড়তে শুরু করেছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা। তবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে আর কয়েকদিন পরে গাছ থেকে আম সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে। তখনই শুরু হবে হাঁড়িভাঙা আমের ভরা মৌসুম।

ক্রেতাদের অভিযোগ, বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হওয়ায় কীটনাশকের ব্যবহার বেড়েছে। অথচ এখনও সম্পূর্ণ পরিপক্ব হয়নি হাঁড়িভাঙা আম। নির্ধারিত সময়ের আগেই কৃত্রিমভাবে আম পাকিয়ে বাজারজাত করায় বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। গাছ থেকে আম সংগ্রহের ৮-১০ দিন আগে অনেকে ছত্রাকনাশক কীটনাশক স্প্রে করেন।

চাষিরা বলছেন, হাঁড়িভাঙা আম পাকলে এটি তিন-চার দিনের বেশি রাখা যায় না। সংরক্ষণের কোনো কার্যকর পদ্ধতিও জানা নেই। যদি এই আম সংরক্ষণের সঠিক প্রক্রিয়া থাকত, তাহলে স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করা সম্ভব হতো। হাঁড়িভাঙা আম সংরক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে একটি বিশেষায়িত হিমাগারের দাবি জানান তারা।

হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদন এলাকা মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ও ময়েনপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, হাঁড়িভাঙা আম বাজারজাত করা হচ্ছে। স্থানীয় বাজারে বাগান থেকে আম সংগ্রহ করে প্লাস্টিকের ক্যারেটে ভরা হচ্ছে। পরে সেগুলো দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাঠাচ্ছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

হাঁড়িভাঙার মৌসুমে আমের সবচেয়ে বড় হাট বসে রংপুরের পদাগঞ্জ হাটে। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। শুক্রবার পদাগঞ্জের হাটে সকাল থেকেই অটোরিকশা, ভ্যান ও পিকআপে করে আসতে থাকে ক্যারেটে ক্যারেটে আম। অনেককেই হাটের রাস্তায় সাইকেল ও ভ্যানে ক্যারেটে আম নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আম বেচতে দেখা গেছে। ক্রেতাদের সরব উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে উঠেছে আমের বেচাকেনা।

পদাগঞ্জ হাটের পাশে একটি গুদাম ঘর থেকে আম ট্রাকে লোড করতে দেখা যায়। এর আশপাশে অনেক ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের জটলা ছিল। স্থানীয় বাসিন্দারা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, এখনও আম পরিপক্ব হয়নি। তার পরও কিছু ব্যবসায়ীরা বাড়তি লাভের আশায় বাগান থেকে আম পেরে বিভিন্ন এলাকায় পাঠাচ্ছেন।

আরেকজন বলেন, অতিরিক্ত গরমের কারণে এবার আগেভাগেই আম পারা শুরু হয়েছে। তবে কেউ কেউ আম পাকাতে স্প্রে মেশাচ্ছেন। যদিও এটা করা অন্যায় এবং এতে হাঁড়িভাঙা আমের প্রকৃত স্বাদ থাকছে না।

পাইকারি ব্যবসায়ী আনারুল ইসলামের ভাষ্য, বাগানে আম পরিপক্ক হয়েছে। বাগান মালিকরা তাকে ডেকে আম বিক্রির কথা বলেন। তাই তাদের কাছ থেকে তিনি আম কিনে বিক্রি করছেন।

আমচাষি ও উদ্যোক্তা মাইনুল ইসলাম বলেন, এবার আবহাওয়া পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকেই আগেই আম পাড়া শুরু করেছে। আমের আকার বা সাইজ ভেদে প্রতিমণ আম সর্বনিম্ন ১ হাজার ২০০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। সহনীয় তাপমাত্রা থাকলে আমের বাজার কিছুটা বেশি হয় বলেও জানান এই ব্যবসায়ী।

তিনি আরও বলেন, হাঁড়িভাঙা আম খেতে সুস্বাদু। একেকটি আম ১৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম হয়। খুচরা বাজারে এর দাম আরও বেশি। কাঁচা আমের তুলনায় আবার পাকা আমের দাম কম। এ ক্ষেত্রে গাছ পাকা আম হলে আবার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এই আম গাছ থেকে সংগ্রহের চার-পাঁচ দিনের মধ্যে পেকে যায়। এ কারণে প্রতি মৌসুমে প্রচুর আম নষ্ট হয়।

শুধু পদাগঞ্জ হাটেই নয়, হাঁড়িভাঙা আমের প্রধান উৎপাদন এলাকা খোঁড়াগাছ, পাইকারহাট, ময়েনপুর, চ্যাংমারী, বালুয়া মাসুমপুর, কুতুবপুর, গোপালপুর, লোহানীপাড়া, রামনাথপুর, কালুপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

এসব এলাকায় আম বিক্রি করার ধুম চলছে। হাটে-বাজারে মানুষের সমাগমে যে কারো মনে হতে পারে এসব এলাকা যেন হাঁড়িভাঙা আমের রাজ্য। সরেজমিনে দেখা গেছে, আমবাগানের মালিক, আমের ফড়িয়া, বাগানের পরিচর্যায় নিয়োজিত ব্যক্তি, মৌসুমি আম বিক্রেতা, অনলাইনে আম বিক্রেতা, পরিবহন ব্যবসায়ী, কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসায়ী—সবাই যে যার মতো করে আম কেনাবেচার জন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন।

এদিকে রংপুর শহরের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সড়ক, সিটি বাজার, লালবাগ, মডার্ন মোড়, ধাপ বাজার, শাপলা চত্বরসহ নগরীর বিভিন্ন হাট-বাজারে উঠতে শুরু করেছে এই আম। হাট-বাজার ছাড়াও পাড়ামহল্লার অলিগলিতে ফেরি করে হাঁড়িভাঙা আম বিক্রি করতে দেখা গেছে। তবে প্রতিবারের মতো এবারও শুরুতেই আমের চড়া দাম চাইছেন বিক্রেতারা।

প্রতিবছর আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে হাঁড়িভাঙা বাজারে আসার তারিখ ঘোষণা করে জেলা প্রশাসন। তবে এ বছর এমন উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। জেলা ও উপজেলা কৃষি বিভাগ ১৫ জুনের পর ‘পরিপক্ব’ আম বাজারজাত করতে চাষি ও ব্যবসায়ীদের পরামর্শ দিচ্ছে।

খোঁড়াগাছ ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ বলেন, আমবাগানে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কম ব্যবহার করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ, চাষি প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী করে থাকেন। বিষমুক্ত আম উৎপাদনে উত্তম কৃষিচর্চা নিয়ে তারা কৃষকদের সঙ্গে কাজ করছেন। আম সংগ্রহের অন্তত ২০-২৪ দিন আগে থেকে কোনো কীটনাশক ব্যবহার না করতে চাষিদের বলা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার কারণে কীটনাশকের ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না।

মিঠাপুকুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুহাম্মদ সাইফুল আবেদীন বলেন, আগের বছরগুলোতে ১৫ থেকে ২০ জুনের মধ্যে হাঁড়িভাঙা আম বাজারে আনার তারিখ দেওয়া হয়েছিল। সে হিসেবে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এবার ১৫ জুনের পরে গাছ থেকে আম সংগ্রহের কথা বলা হচ্ছে।

উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুলতামিস বিল্লাহ বলেন, গাছ থেকে অপরিপক্ব আম পারা ও ফরমালিন মেশানোর ব্যাপারে কোনো অভিযোগ কেউ দেয়নি। কোথাও এটা করে থাকলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জেলায় হাঁড়িভাঙা আম আবাদ করা জমির পরিমাণ ১ হাজার ৯১৫ হেক্টর। এর মধ্যে মিঠাপুকুরে ১ হাজার ২৬৮। জেলায় সম্ভাব্য হাঁড়িভাঙা আমের উৎপাদন ধরা হয়েছে ২৯ হাজার ৮৫১ মেট্রিক টন।

আমচাষি, ব্যবসায়ী ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গড়ে ৫০-৬০ টাকা কেজি ধরলেও হাঁড়িভাঙা আমকে কেন্দ্র করে রংপুরে এ মৌসুমে প্রায় ২০০ কোটি টাকার লেনদেন ছাড়িয়ে যাবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুরের উপপরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, হাঁড়িভাঙা আমের মাধ্যমে রংপুরের কৃষি অর্থনীতি চাঙা হয়েছে। এ বছর আমগাছে মুকুল কম এলেও আমের আকার ও ফলন ভালো হয়েছে। তবে অতিরিক্ত গরমের কারণে নির্ধারিত সময়ের আগে হাঁড়িভাঙা বাজারে এসেছে।

এদিকে জনপ্রিয়তার কারণে মিঠাপুকুর, বদরগঞ্জ ও সদর উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে এখন রংপুরের তারাগঞ্জ, নীলফামারী জেলার সদর, সৈয়দপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, খানসামা, চিরিরবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে হাঁড়িভাঙা আমের বাগান। ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে এসব বাগান।

জানা গেছে, রংপুর অঞ্চলে হাঁড়িভাঙা আমের ফলন বেশি হলেও ফজলি, সাদা ল্যাংড়া, কালা ল্যাংড়া, মিশ্রিভোগ, গোপালভোগ, আম্রপালিসহ আরও নানা প্রজাতির আম উৎপাদন হয়ে আসছে। এসব আমের ভিড়ে এখন সবচেয়ে বেশি চাহিদা হাঁড়িভাঙার। সম্প্রতি হাঁড়িভাঙা আম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top