‘হাসিনা চলে গেছে শুনে মনে হয়েছিল আমার অন্ধত্ব কামিয়াব হয়েছে’
প্রকাশিত:
৫ আগস্ট ২০২৫ ১৬:৩০
আপডেট:
৫ আগস্ট ২০২৫ ১৮:৫৩

‘হাসিনা চলে গেছে শুনে ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিল আমার অন্ধত্ব কামিয়াব হয়েছে। আমি যেটা হারিয়েছি সেটা দিয়ে আমি না হলেও অন্যরা অন্তত সারা দেশটাকে দেখতে পারবে। কিন্তু হাসিনা যদি কোনো মতে টিকে যায় তো, তাহলে আরও হাজার-লাখ লাশ ফেলে দিতো। কিন্তু সেই বাংলাদেশ মুক্তিটা দেখতে পারত না, যেই মুক্তিটা দেখার জন্য আমার চোখ গেছে।’
এভাবেই এই কথাগুলো বলছিলেন খুলনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে চোখ হারানো জুলাইযোদ্ধা আব্দুল্লাহ আল শাফিল।
শাফিল বলেন, ২ আগস্ট সংঘর্ষের ঘটনায় আমার চোখ হারায়। ঢাকায় চিকিৎসার জন্য গেলেও হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হতে পারিনি। শাহবাগে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে ও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছি। ৫ আগস্ট দুই চোখেই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আত্মীয়-স্বজনকে বলতাম টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিতে। খোঁজ রাখতাম আমার আর কতজন ভাই শহীদ হয়েছে, হাসিনার পতন ঘটেছে কিনা। এসব নানা বিষয়ে সংবাদ শোনার জন্য বসে থাকতাম। যখন শুনলাম হাসিনা চলে গেছে তখন আমার গায়ের রক্ত কিছুক্ষণের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল। তখন ভাবছিলাম যে এটি জাতির জন্য বিশাল বড় কোনো ষড়যন্ত্র অথবা এটি জাতির জন্য বিশাল বড় মুক্তির সংবাদ। তখন আমার চোখে যে ব্যথা, সেটি কোনো স্মৃতিতেই ছিল না। চোখে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু ওই মুহূর্তে আমার সেই সেন্স কাজ করছিল না।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট খুলনার রাজপথে মিছিল-বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠে
দিনটি ছিল সোমবার। এদিন সকাল থেকে খুলনা মহানগরীর শিববাড়ি মোড়ে জড়ো হতে থাকে ছাত্র-জনতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নামে ছাত্র-জনতার ঢল। আড়াইটা নাগাদ আন্দোলনরত অবস্থায় শিক্ষার্থীরা খবর পান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। এরপরই বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়েন শিববাড়ী এলাকায় থাকা হাজার হাজার মানুষ। খুলনার সড়কে নেমে আসে ছাত্র-জনতা। মায়েরা সন্তানকে কোলে নিয়ে, বাবারা সন্তানকে কাঁধে নিয়ে জাতীয় পতাকা হাতে খুলনার সড়কে নেমে আসেন। সবশ্রেণি-পেশার মানুষের পদচারণায় খুলনার রাজপথ সরগরম হয়ে ওঠে। পথে পথে বিতরণ করা হয় মিষ্টি। এ সময় নগরীর বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ পায়ে হেঁটে, সাইকেল, ভ্যান, রিকশা, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শিববাড়ীর দিকে ছুটতে থাকেন। মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো খুলনা। অনেকেই বলেন দেশ আবার নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। এ এক নতুন স্বাধীনতা, নতুন বাংলাদেশ।
সেদিন শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, ভাষা আন্দোলন দেখিনি, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। তবে আজ ২০২৪ দেখলাম। ছাত্র-জনতার বিজয় হয়েছে। মানুষের এই উল্লাস দেখার মতো। আরেকটি স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করেছি।
তারা বলেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের উল্লাস দেখিনি, তবে ২০২৪ এর আজকের বিজয় দেখে মনে হচ্ছে দেশ আবার নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। মানুষের মধ্যে তেমনই আনন্দ উল্লাস বিরাজ করছে।
৫ আগস্টের স্মৃতি তুলে ধরে যা বললেন আন্দোলনের নেতারা
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুলনা মহানগরের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও খুবির সাবেক ছাত্র সমন্বয়ক নাঈম মল্লিক বলেন, খুলনায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যারা পরিচালনা করতো তারা ৪ আগস্টই বিতাড়িত হয়। ৫ আগস্ট সকাল থেকে আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছিলাম শিববাড়ী মোড়ে। সেখানেই শুনেছিলাম সেনাপ্রধান ভাষণ দেবেন। সবাই অপেক্ষার প্রহর গুনছিলাম। তারপরই হঠাৎ করে বিকেলে খবর আসে যে ‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ’ করেছেন। তারপরই আমরা বিজয় মিছিল নিয়ে হাদিস পার্কে শহীদ মিনারে যাই। সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে শিববাড়ী ফিরে আসি। এদিন কিছু স্থানে বিশৃঙ্খলা হয়েছিল। এরপর খুবি ক্যাম্পাসে গিয়ে আমরা ওই দিন টিম ভাগ করে খুলনাবাসীর নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন জায়গায় টহল দেই।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে আমরা দেখেছি মানুষ নাচ-গান করেছে, মিষ্টি বিতরণ, মিছিল, স্লোগান দিয়েছে, সন্তানদের নিয়ে বাবা-মা সড়কে নেমেছে ইতিহাসের সাক্ষী হতে। অনেকেই খাবার বিতরণ করেছে।
এর কারণ উল্লেখ করে জুলাইযোদ্ধা নাঈম মল্লিক বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এটি শুধু বৈষম্য বা কোটা কেন্দ্রিক ছিল না, অনেকে দলীয় কারণে বৈষম্যের শিকার, অনেকে মতাদর্শের কারণে, অনেকে ভোট দিতে পারেনি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে পারতো না। এই ধরনের মিশ্রিত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখেছি ৫ আগস্ট। সবাই উল্লাস করেছে। সবাই মনে করেছে আমরা একটা ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছি। এটি নতুন স্বাধীনতার স্বাদ। ১৬ ডিসেম্বরের অতীতের যে ছবিগুলো দেখা যায়, সেই রকমেরই একটা অবস্থা ছিল। মনে হচ্ছিল সবাই মুক্ত বাতাসে স্বাদ নিতে বেড়িয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, ৪ আগস্ট থেকেই মানুষকে আর ঘরে রাখা যায়নি। ৫ আগস্ট যখন খবর আসলো হাসিনা দেশত্যাগ করেছে, তখন সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত ছিল বাড়ির মহিলারা ছোট ছোট শিশু বাচ্চাদের কোলে নিয়ে রাজপথে নেমেছিল। তারাও আনন্দ উদযাপন করেছে। তাদের দেখে ঈদের থেকেও বেশি খুশি মনে হয়েছে।
তিনি বলেন, হাসিনা পতনের সারথি, হাসিনা পতনের একজন সৈনিক হিসেবে আমরা নিঃসন্দেহে নিজেদেরকে গর্বিত মনে করেছি। রাজপথে দেখেছি বাড়ির সকলে রাস্তায় নেমে এসে উল্লাস করেছে।
সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি বলেন, জুলাই আন্দোলনে আমাদের ২ হাজার মানুষ জীবন দিয়েছে। শত শত শিশুরা জীবন দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ তাদের চোখ হারিয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেছে। আমাদের একটাই চাওয়া এই ২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থানে হাজার হাজার মানুষের ত্যাগ যেন বৃথা না যায়। মানুষের যে চাওয়া নতুন বাংলাদেশ, এই দেশে আর যেন কখনো কোনো ফ্যাসিবাদের জন্ম না হয়। নতুন বাংলাদেশের যে চাওয়া সেটি আমরা বাস্তবায়ন দেখতে চাই।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: