ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় : প্রতিষ্ঠার দর্শন, অর্জনের পথচলা ও আজকের প্রত্যাশা
প্রকাশিত:
২২ নভেম্বর ২০২৫ ১৫:২৬
আপডেট:
২৩ নভেম্বর ২০২৫ ১৫:১০
বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী রাষ্ট্র গঠনের যাত্রায় যে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ আদর্শিক ভূমিকা বহন করে এসেছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ) তাদের অন্যতম। ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কুষ্টিয়ার শান্তিধরা গ্রামের মাটিতে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় এমন একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো, যেখানে ইসলামী জ্ঞান-চর্চা, আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মানবিক বিদ্যার সঙ্গে সহাবস্থান করবে। পরবর্তীতে ২৭ ডিসেম্বর ১৯৮০ জাতীয় সংসদে ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৮০’ পাস হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি পূর্ণ আইনি স্বীকৃতি পায়। প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পান এ. এন. এম. মমতাজ উদ্দীন চৌধুরী।
এই ইতিহাসই বলে দেয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; এটি রাষ্ট্রের একটি দর্শন, শিক্ষাব্যবস্থার একটি প্রতিশ্রুতি এবং শেকড়-সন্ধানী এক যুগান্তকারী প্রয়াস।
প্রতিষ্ঠার পটভূমি: সময়ের স্রোতে একটি শিক্ষাদর্শ
১৯৭০-এর দশকের শেষভাগে বাংলাদেশের শিক্ষা খাত নানা সংকটের মুখোমুখি। ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে আধুনিক জ্ঞানচর্চার সমন্বিত কাঠামো তখনো অনুপস্থিত। মাদ্রাসা এবং সাধারণ শিক্ষার দ্বৈতধারা সমাজে দূরত্ব তৈরি করছিল। রাষ্ট্রচিন্তায় তাই প্রশ্ন উঠেছিল—বাংলাদেশে একটি এমন প্ল্যাটফর্ম কি তৈরি করা যায় না, যেখানে দু’ধারার শিক্ষা এক সেতুবন্ধন রচনা করতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তরই ছিল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়—একটি আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে ইসলামী স্টাডিজ যেমন থাকবে, তেমনি বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, আইন, ব্যবসায় শিক্ষা এবং আধুনিক মানবিক বিদ্যার সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে।
১৯৭৯ সালের সেই ভিত্তিপ্রস্তর শুধু একটি ভবন নির্মাণের সূচনা নয়; এটি ছিল জ্ঞানচর্চার একটি নতুন ধারার সূচনা।
অর্জনের তিন দশক: পথচলার উচ্চতা ও চ্যালেঞ্জ
চারটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও আজ বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। কয়েকটি নির্দিষ্ট অর্জন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—
১. একাডেমিক সম্প্রসারণ ও বহুমাত্রিক শিক্ষা
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮টি অনুষদের অধীনে মোট ৩৬টি বিভাগ, ৩৯ জন বিদেশি শিক্ষার্থীসহ মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা বর্তমানে ১৫৪১৭ জন। শিক্ষক রয়েছেন ৪১২ জন, কর্মকর্তা ৪২৫ জন ও কর্মচারীর সংখ্যা ৩৯৯ জন।
২০১৯ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪৬৪ জন পিএইচডি ও ৬৬৬ জন এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ধর্মতত্ত্ব, ইসলামের ইতিহাস-সংস্কৃতি, সাহিত্য থেকে শুরু করে কম্পিউটার বিজ্ঞান, পুষ্টি, আইন, বাংলা, অর্থনীতি, ব্যবসায় শিক্ষা—এ যেন জ্ঞানচর্চার এক বিস্তৃত ভুবন।
২. গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ
পিএইচডি ও এমফিল প্রোগ্রাম এখন নিয়মিত ও সমৃদ্ধ। ইসলামি অর্থনীতি, সুফিবাদ, লোকসংস্কৃতি, সমসাময়িক সাহিত্য, ICT—বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণা দেশের নীতি নির্ধারণী আলোচনাতেও প্রভাব ফেলছে।
৩. ক্যাম্পাস সংস্কৃতি ও আঞ্চলিক উন্নয়ন
ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। হাজারও শিক্ষার্থীর উপস্থিতি স্থানীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করেছে; সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা অঞ্চলে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে।
৪. শিক্ষার্থীদের বহুমাত্রিক অর্জন
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সাফল্য—প্রযুক্তি প্রতিযোগিতা, রোবটিক্স, বিতর্ক, সাহিত্যচর্চা, ব্যাংকিং ও বিচার ব্যবস্থায় শীর্ষস্থানীয় ভূমিকা—প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতার সাক্ষ্য দেয়।
৫. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও একাডেমিক সহযোগিতা
বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা সমঝোতা ও শিক্ষক-বিনিময় চুক্তি ইবির শিক্ষার পরিধিকে আরও বিস্তৃত করেছে।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মতো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রায়ও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে—
বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্রুত সম্প্রসারণের তুলনায় নতুন ভবন, ল্যাব, আবাসন ও ডিজিটাল অবকাঠামোর উন্নয়ন যথেষ্ট হয়নি। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা শিক্ষার অনুকূল পরিবেশকে প্রভাবিত করেছে। সমকালীন বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থায় যেটি প্রায়ই দেখা যায়, ইবিও তার বাইরে নয়।
গবেষণা বরাদ্দ ও আধুনিক ল্যাব ঘাটতি রয়েছে। যেখানে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণায় নিরবচ্ছিন্ন অর্থায়ন প্রয়োজন, সেখানে গবেষণা খাতে বরাদ্দ এখনো পর্যাপ্ত নয়।
দীর্ঘসূত্রিতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধীরগতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করেছে।
এসব সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেই এগোতে হবে; কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানেই একটি চলমান বিবর্তন।
আজকের প্রত্যাশা: যে বিশ্ববিদ্যালয় সামনে দেখতে চায় বাংলাদেশ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে আজ কয়েকটি বড় লক্ষ্য ও প্রত্যাশা রয়েছে—
১. গবেষণা-সমৃদ্ধ আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়
শুধু শিক্ষা নয়, গবেষণাই হবে মূল শক্তি—এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রয়োজন আধুনিক ল্যাব, আন্তর্জাতিক মানের জার্নাল এবং বৈশ্বিক গবেষণা সহযোগিতা।
২. প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র
ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশের প্রেক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে হতে হবে একটি প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞানকেন্দ্র—AI, রোবটিক্স, ডেটা সায়েন্স, গ্রিন টেকনোলজি যেখানে গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র।
৩. ইসলামী অর্থনীতি ও নৈতিক শিক্ষার কেন্দ্র
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং দ্রুত বিস্তৃত। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় একটি নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে।
৪. ক্যাম্পাস প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা
অনলাইন সেবা, ডিজিটাল আর্কাইভ, সময়মতো পরীক্ষা, দ্রুত ফল প্রকাশ—এগুলো শিক্ষার্থীর মৌলিক অধিকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থায় ডিজিটাল সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
৫. আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ
বিশ্বমানের শিক্ষা দিতে হলে বিশ্বমানের শিক্ষক চাই। নিয়মিত প্রশিক্ষণ, বিদেশে প্রশিক্ষণ, গবেষণা সুযোগ বাড়ানো প্রয়োজন।
৬. নিরাপদ, আধুনিক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্যাম্পাস সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস হতে হবে—
মুক্তচিন্তার, সহনশীলতার, সৃজনশীলতার এক সমন্বিত আবাস।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় তখনই পূর্ণতা পায়, যখন এটি কেবল বিদ্যা দেয় না বরং মানুষ গড়ার নৈতিক দায়ও বহন করে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল একটি আদর্শিক সমন্বয়—ইসলামী জ্ঞান ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যকার দূরত্ব দূর করা। চার দশকের বেশি পথচলায় বিশ্ববিদ্যালয়টি অনেক অর্জন সঞ্চয় করেছে—কখনো আলোর, কখনো বিতর্কের, কখনো সম্ভাবনার। কিন্তু আজকের প্রত্যাশা আরও বড়—এটি যেন হয়ে ওঠে একটি আধুনিক গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়, একটি মানবিক ও প্রযুক্তিনির্ভর জ্ঞানকেন্দ্র এবং একই সঙ্গে নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও মুক্তচিন্তার সমন্বিত পাঠশালা।
রাষ্ট্রের আশা, অঞ্চলের দাবি এবং সময়ের প্রয়োজন—সব একত্রে বলছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এখন নতুন উচ্চতায় ওঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
অধ্যাপক ড. মো. হাছানাত আলী : প্রাক্তন ছাত্র, ইবি ও উপাচার্য, নওগাঁ বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: