ছাত্রদল করায় হাত কেটে নেওয়া হয় মাসুদের, ১১ বছরেও পাননি ন্যায়বিচার
প্রকাশিত:
২৬ নভেম্বর ২০২৫ ২০:৫৪
আপডেট:
২৭ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:১০
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চর এলাহী ইউনিয়নের গাংচিল গ্রামের মো. আমিনুল হক মাসুদের জীবন থমকে গেছে এক ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায়। ডিগ্রি পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি, পরিবারের স্বপ্ন পূরণের প্রত্যাশা, সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারির সেই রক্তাক্ত সন্ধ্যায়।
মাত্র ৭ দিন পর ছিল মাসুদের ডিগ্রি পরীক্ষা। স্থানীয় বাজারে বিএনপির নির্বাচনী অফিসে বসে ছিলেন তিনি। হঠাৎ আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা অতর্কিত হামলা চালালে মারাত্মকভাবে আহত হন। হামলায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার ডান হাতের কবজি। আর কোনোদিন ফিরতে পারেননি পরীক্ষার হলে। আজ তিন সন্তানের জনক হলেও সন্তানদের মাথায় স্বাভাবিকভাবে হাত বুলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও নেই তার। সংসার চালানোই এখন সবচেয়ে বড় সংগ্রাম।
মাসুদ ওই সময় চর এলাহী ইউনিয়ন ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি ছিলেন। একই হামলায় তার বড় ভাই ছেরাজুল হক বাবুলের দুই আঙুল কেটে যায়। মাসুদের হাতের অবশিষ্ট অংশ ফিরিয়ে দিতে দুই লাখ টাকা দাবির ঘোষণা দেওয়া হলেও কখনই ফেরত পাননি তারা। বরং পরবর্তীতে জানতে পারেন— সেদিন তার বিচ্ছিন্ন হাত আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। হামলার ভয়, রাজনৈতিক প্রভাব, সব মিলিয়ে মামলা করতে পারেননি মাসুদ। জুলাই আন্দোলনের পর ২০২৪ সালের অক্টোবরে বাধ্য হয়ে ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন তিনি।
আমিনুল হক মাসুদ বলেন, গত ১৪ বছরে আমি অনেক কিছু হারিয়েছি— স্বপ্ন, পড়াশোনা, নিজের দুই চোখের সামনে দেখা ভবিষ্যৎ। ডান হাতটা হারিয়েছি ঠিকই, কিন্তু ন্যায়বিচার পাওয়ার আশাটা এখনো হারাইনি। সন্তানদের মুখের দিকে তাকালে বুকটা হু হু করে। তাদের জন্যই বেঁচে আছি। আমি কোনো রাজা-মন্ত্রী কিছু চাই না, শুধু মানুষ হিসেবে বাঁচার সুযোগ চাই। যারা আমার জীবনটা এভাবে থামিয়ে দিয়েছে, তাদের বিচার হোক— এটাই আমার একমাত্র দাবি।
মাসুদের বাবা ছায়েদল হক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বড় ছেলে ছেরাজুল হক বাবুলের দুইটা আঙুল এবং ছোট ছেলে মাসুদের ডান হাতের কবজি কেটে ফেলায় তারা কষ্ট করেই যাচ্ছেন। বিশেষ করে ছোট ছেলে মাসুদের জীবনটা এভাবে ধ্বংস হবে ভাবতে পারিনি। এখনো সে প্রতিদিন দম বন্ধ করা কষ্টে দিন কাটায়। আমার চোখের সামনে ছেলের এমন কষ্ট আমি মেনে নিতে পারি না। আমি সহ্য করতে পারি না। ছেলেটাকে নিয়ে আমি পরিবার আগলে রেখেছি। আমার মৃত্যুর পর তার কী হবে তা আমার জানা নেই।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নোয়াখালী জেলা কৃষক দলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আক্তার হোসেন বলেন, শুধুমাত্র ধানের শীষের ভোট করায় সেদিন আমিসহ প্রায় ১০ জনের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আমরা প্রচারণা করছি, আওয়ামী লীগও করছে। হু হু করে অস্ত্র হাতে হামলা করে কারো কবজি, কারো হাত কারো আঙুল কেটে দেয় সন্ত্রাসীরা। সেদিনের কথা মনে পড়লে চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ে। কান্না থামাতে পারি না।
স্থানীয় বাসিন্দা ওসমান গনি আক্ষেপ করে বলেন, মাসুদ এক সময় খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। চাকরি করে পরিবারকে দাঁড় করানোর স্বপ্ন ছিল তার। রাজনীতির নামে একজন তরুণের জীবন নষ্ট হয়ে গেল। অথচ কেউ খোঁজও নেয় না। ১৪ বছর ধরে মাসুদ শুধু বেঁচে আছে, বেঁচে থাকা নয়— এ যেন প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই।
মাছুদের ভাই ছেরাজুল হক বাবুল বলেন, আমরা কৃষি কাজ করি আর বিএনপি করি। আমার বাবার আদর্শ দেখে আমরা বড় হয়েছি। আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে ফেলেছে আওয়ামী লীগ। আমরা বাড়িতে ঘুমাতে পারতাম না। আমাদের কোনো সামাজিকতা ছিল না। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। আসামিরা গ্রেপ্তার হয়, আবার অনেকে বুক ফুলিয়ে হাটে। আমাদের নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছিলেন- আমার ভাইকে একটা চাকরি দেবেন, কিন্তু তিনি তো মারা গেছেন। আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো আর কোনো নেতা আমরা পাইনি।
নোয়াখালী-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রাপ্ত ফখরুল ইসলাম বলেন, ১৪ বছর পরে আজও আমিনুল হক মাসুদ ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়। চিকিৎসা, কৃত্রিম হাত, পুনর্বাসন, স্থায়ী উপার্জনের ব্যবস্থা— সবকিছুই তার জীবনে জরুরি প্রয়োজন। নিঃশব্দে নিজের যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানো এই মানুষটি আজ কোম্পানীগঞ্জের রাজনৈতিক সহিংসতার এক জীবন্ত সাক্ষী। একজন তরুণের স্বপ্ন যেন কখনোই এমনভাবে থেমে না যায়—এটাই এলাকার মানুষের প্রার্থনা।
কোম্পানীগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গাজী মুহাম্মদ ফৌজুল আজিম বলেন, জুলাই আন্দোলনের পর মামলাটি দায়ের হয়। আসামিরা দেশ-বিদেশে থাকায় আমরা সবাইকে আইনের আওতায় আনতে পারি নাই। এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছি। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: