জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান
প্রকাশিত:
২৬ আগস্ট ২০২৫ ১৪:০২
আপডেট:
২৬ আগস্ট ২০২৫ ১৭:৩১

মানবসভ্যতার ইতিহাসে কিছু পাপ রয়েছে যা বারবার মানুষের পতনের কারণ হয়েছে। পরকীয়া, ব্যভিচার ও অবৈধ প্রেম তার অন্যতম।
ইসলাম একে শুধু গুনাহ নয়, বরং বিশ্বাসঘাতকতা ও সভ্যতার জন্য মরণব্যাধি হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবুও আজকের পৃথিবীতে অনেকেই এটিকে আর অপরাধ মনে করে না। আধুনিকতার নামে, ভালোবাসার ছদ্মবেশে মানুষ সহজেই জড়িয়ে পড়ছে অবৈধ সম্পর্কে।
অথচ কুরআন স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে—“তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল কাজ এবং বিপজ্জনক পথ।” (সূরা আল-ইসরা: ৩২)
ইসলামের দৃষ্টিতে এই অপরাধের শাস্তি কঠোর। ব্যভিচারকারীদের শাস্তি হিসেবে অন্য একটি আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘ব্যভিচারকারী নারী ও পুরুষ উভয়কে ১০০টি করে বেত্রাঘাত করো’ (সুরা: নুর ২)।
এটা অবিবাহিত জিনাকারীর শাস্তি। আর পরকীয়া কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে বিবাহিত নারী-পুরুষ যদি জিনায় লিপ্ত হয়, তাদের জন্য ইসলামে আরও ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে। পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাদের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে ইসলাম। যা নবী করিম সা. এর যুগে কার্যকর হয়েছিল কেবল স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তির পর।
এত কঠোর শাস্তি প্রয়োগের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে সীমারেখা থেকে দূরে রাখা। কারণ পরকীয়া শুধু দম্পতির মধ্যে নয়, বরং পুরো পরিবার, সন্তান, এমনকি সমাজের ভিত্তিকে ভেঙে দেয়।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে—যেখানে পরিবার ভেঙেছে, সেখানেই রাষ্ট্র ভেঙে পড়েছে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পেছনে ছিল নৈতিক অবক্ষয় ও পরিবার ভাঙনের অগ্নি। গ্রীসের শক্তি ক্ষয় হয়েছিল অবাধ যৌনাচারের আগুনে।
অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ সময়ে অভিজাত সমাজে অবৈধ সম্পর্কের প্রসার তাদের রাজনৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করেছিল। ইতিহাস তাই আমাদের শিখিয়ে দেয়, পরিবার নিরাপদ থাকলেই সভ্যতা নিরাপদ থাকে।
আজকের সমাজে অবস্থা আরও ভয়াবহ।বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পরিবার আদালতের নথি বলছে, বিচ্ছেদের মামলার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পরকীয়া।
২০২২ সালের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, প্রতি দশটি তালাকের মধ্যে চারটির পেছনে পরকীয়া বা অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগ রয়েছে। পাশ্চাত্যে এই হার আরও ভয়াবহ, যেখানে শতকরা বিশ শতাংশের বেশি শিশু জন্ম নিচ্ছে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক থেকে। (পিউ রিসার্চ সেন্টার, ২০২০)। এর সামাজিক প্রভাব প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহন করতে হচ্ছে।
মনোবিজ্ঞান বলছে, অবৈধ সম্পর্ক দম্পতির মধ্যে বিশ্বাস ধ্বংস করে দেয়। যে দম্পতি একসময় নিরাপত্তা খুঁজতো একে অপরের মাঝে, সেখানে জন্ম নেয় সন্দেহ ও অবিশ্বাস। আর এই বিষাক্ত আবহ সবচেয়ে বেশি আঘাত হানে শিশুদের মনে। (জার্নাল অব ফ্যামিলি সাইকোলজি, ২০২১)
গবেষণা বলছে, এ ধরনের পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুরা স্কুলে মনোযোগ হারায়, মানসিক অস্থিরতা ভোগে, এবং পরবর্তী জীবনে সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়।
এখানেই শেষ নয়। কিশোর-কিশোরী, ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অবৈধ প্রেম আজ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। মোবাইল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সিনেমা-সংগীতের প্রভাবে তারা প্রেমের নাম করে জড়িয়ে পড়ছে হারাম সম্পর্কে। কৈশোরের আবেগ, অপরিণত মানসিকতা ও সামাজিক চাপ তাদেরকে এমন পথে ঠেলে দিচ্ছে, যেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন। এর ফলে তারা পড়াশোনায় ব্যর্থ হচ্ছে, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে, এবং অনেক ক্ষেত্রে আত্মহননের মতো মারাত্মক পদক্ষেপ পর্যন্ত নিচ্ছে।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন: “যখন একজন মানুষ জিনা করে, তখন ঈমান তার অন্তর থেকে সরে যায়।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। অর্থাৎ এটি কেবল সামাজিক অপরাধ নয়, এটি আধ্যাত্মিক মৃত্যু। এ গুনাহ মানুষকে আল্লাহর করুণার ছায়া থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
পরকীয়া কোনো প্রেম নয়—এটি আগুন, যা ধ্বংস করে দেয় বিশ্বাস, পরিবার, সন্তান, সমাজ ও সভ্যতা। এটি রোমান্টিকতা নয়, বরং সর্বনাশের হাতিয়ার। ইসলাম যে কঠোর শাস্তির কথা বলেছে তা ভয়ের দেয়াল, কিন্তু প্রকৃত প্রতিরোধ নিহিত আছে আল্লাহভীতি, নৈতিক শিক্ষা, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক সচেতনতার মধ্যে।
আজকের বিশ্বে আমাদের একটিই বার্তা উচ্চারণ করতে হবে—সত্যিকারের প্রেম হালাল সম্পর্কে, বিবাহের পবিত্র বন্ধনে। অবৈধ প্রেম কোনো ভালোবাসা নয়; এটি কেবল ক্ষত, বিষ এবং ধ্বংস। ইতিহাস আমাদের সতর্ক করেছে, বর্তমান আমাদের চোখের সামনে উদাহরণ সাজিয়ে দিয়েছে, আর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে আমাদের সিদ্ধান্তের জন্য।
আমরা কি এই অগ্নি থেকে পরিবারকে রক্ষা করব, নাকি অবৈধ সম্পর্কের বিষ আমাদের সভ্যতাকে গ্রাস করবে—সেটিই আজকের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: