৪ ঘণ্টায় ৩০ হাজার টাকার চটপটি বিক্রি করেন মামুন
প্রকাশিত:
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:১৬
আপডেট:
১৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:৩০
ফরিদপুর শহরের মুজিব সড়কের পাশে ভ্যানে করে বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চটপটি বিক্রি করেন মো. মামুন হোসেন (৪১)। প্রতিদিন মাত্র ৪ ঘণ্টায় ৩০-৩২ হাজার টাকার চটপটি বিক্রি করেন।
এতে সব খরচ বাদে মাসে ৯০ হাজার টাকা লাভ থাকে তার। এতে নিজের পরিবারের পাশাপাশি আরও পাঁচ কর্মচারীর পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়েছেন তিনি। চটপটি বিক্রি করে সুনাম কুড়িয়েছেন হাজারো মানুষের।
মামুন হোসেনের বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলায়। তিনি উপজেলার দাঁতপুর ইউনিয়নের কোন্দারদিয়া গ্রামের বাদশা মোল্লা (৬৫) ও পেয়ারী বেগম (৬০) দম্পতির ছেলে। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে মামুন সবার বড়। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
ছোট ভাই মুরাদ হোসেন রংমিস্ত্রির কাজ করেন। মামুন বিবাহিত। তার স্ত্রীর নাম রিতা বেগম (৩৫)। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা মামুন। ছেলে ইসমাইল হোসেন ও মেয়ে মিম আক্তার মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছে। বোয়ালমারীতে বাড়ি হলেও গত ১৫ বছর ধরে তিনি ফরিদপুর শহরের আলীপুর মহল্লায় বাসা ভাড়া করে বসবাস করছেন।
মামুন হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবিকার প্রয়োজনে কখনো রাজশাহী কখনো ফরিদপুরে ভাঙারি পণ্যের ব্যবসা, চানাচুর মাখা বিক্রি আবার কখনো পাপড় বা ভাজাপোড়া বিক্রি করেছেন। ২০১৫ সাল থেকে ‘শাহী চটপটি ও হালিম’ নামের ভ্রাম্যমাণ দোকানে চটপটি ও হালিম বিক্রি করা শুরু করেন তিনি।
তবে বর্তমানে হালিম বাদ দিয়ে শুধু চটপটিতেই তিনি মনোনিবেশ করেছেন। শুরুতে তিনি একাই থাকলেও তার হাতের জাদুতে ভোজনরসিকরা আকৃষ্ট হন। চারিদিকে দোকানের নাম ছড়িয়ে পড়ে, মানুষ আসতে শুরু করে বেশি। তখন মামুনের একার পক্ষে বাটি ধোয়া, পার্সেলের জন্য প্যাকেট করা ও চটপটি বানানো কঠিন হয়ে পড়ে।
এরপর এসব কাজে সাহায্যের জন্যে একে একে পাঁচজন কর্মচারী নিয়োগ করেন তিনি। এদের একজন পার্সেলের প্যাকেট করেন, একজন বাটি ধোয়া-মোছা করেন, একজন ক্রেতাদের পানি খাওয়ান ,একজন মামুনের পাশে দাঁড়িয়ে বাটিতে টক দেওয়ার কাজ করেন এবং আরেকজন চটপটির দাম রাখেন। আর এদের মধ্যমনি হয়ে মামুন ডাল, হাঁসের ডিম, ধনিয়া পাতা, ফুসকা ও বিভিন্ন রকম মসলার মিশ্রণে বানান লোভনীয় এক বাটি চটপটি।
সরেজমিনে মামুনের দোকানের সামনে গিয়ে দেখা যায়, বিকেল ৫টার আগেই শহরের বাটার শো-রুমের সামনে অনেকে এসে চটপটির জন্যে অপেক্ষা করছেন। ৫টা বাজার কিছু সময়ের মধ্যেই দোকান নিয়ে হাজির হন মামুন ও তার কর্মচারীরা। এরপর যে যার মতো নিজ নিজ কাজে লেগে পড়েন।
মামুন পরিষ্কার পানি দিয়ে হাত ধুয়ে দুই হাতে দুটি সাদা গ্লাভস পরে নেন। এরপর মানুষ গুনে শুরু করেন চটপটি বানানো। প্রতিবার ৩০ থেকে ৩৫ বাটি চটপটি বানান তিনি। এর মধ্যে উপস্থিত ক্রেতাদের চাহিদা মিটিয়ে যারা বাসার জন্য পার্সেল নিতে চান তাদেরকে সাদা প্লাস্টিকের বাটিতে করে স্কচটেপ পেঁচিয়ে পার্সেল করে দেন।
মামুনের প্রতি বাটি চটপটির দাম ৮০ টাকা। পার্সেলে প্লাস্টিকের বাটি যোগ হওয়ার কারণে ২০ টাকা বাড়িয়ে পার্সেলের দাম নেন ১০০ টাকা। দোকানটি ফুটপাতে হওয়ায় অনেক সময় ক্রেতাদের ভিড়ে পাশের বাটার শো-রুমের সামনে জটলা লেগে যায়। এজন্য চটপটি বানানোর ফাঁকে ফাঁকে মামুন তার ক্রেতাদের অনুরোধ করেন ফুটপাত ছেড়ে মূল সড়কে এসে দাঁড়াতে। মামুনের দোকানের দুই পাশে আরও কয়েকটি চটপটির দোকান রয়েছে। তবে ওসব দোকানে তেমন ভিড় দেখা যায় না।
মামুন বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দোকান করেন। মাঝে মাঝে এর থেকেও কম সময় দোকান করেন। কখনো অসুস্থ হলে কর্মচারীরা দোকান চালান। তবে সেক্ষেত্রে ক্রেতা কম পাওয়া যায়। কারণ সবাই মামুন ভাইয়ের চটপটি খেতে এসে মামুন ভাইকে খোঁজেন। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এই চটপটির সুনাম বৃহত্তর ফরিদপুর তো বটেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক ক্রেতা ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে চটপটি খেয়ে যান। অনেক ফুড ব্লগার এসে ভিডিও করেন, সাক্ষাৎকার নেন।
মামুনের দোকানে চটপটি খেতে আসা সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী আরিফ (২৪) বলেন, এই শহরে অনেক দোকান আছে চটপটির। অন্য দোকান থেকে এ দোকানের চটপটির স্বাদ ভিন্ন। এখানে হাঁসের ডিম ব্যবহার করা হয়, টাটকা-মচমচে ফুসকা দেওয়া হয় চটপটির মধ্যে। উনার আন্তরিকতা অনন্য। উনার মতো করে ফরিদপুর শহরে আর কেউ চটপটি বানায় না। এজন্য আমরা প্রায়ই দলবেঁধে এই চটপটি খেতে আসি।
জীবনের প্রথম এই চটপটি খেতে এসেছেন নীলা (২২) নামে এক তরুণী। তিনি বলেন, ইউটিউবে একটি ফুড রিভিউয়ের ভিডিও দেখে এই চটপটি খেতে এসেছি। স্বাদ ও মানের যে বিবরণ শুনেছিলাম সেটি যাচাই করতেই দুজন বান্ধবীকে নিয়ে এসেছি চটপটি খেতে।
ফরিদপুর টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম (৩৯) বলেন, মামুন ভাইয়ের চটপটির সুনাম অনেক শুনেছি। অনেক সহকর্মীও এর অনেক প্রশংসা করেছেন। আজকে প্রথম খেয়ে দেখলাম। আসলেই এটা প্রশংসা করার মতো চটপটি, এই খাবারের প্রশংসা করা যায়।
চটপটি জনপ্রিয় হওয়ার পেছনের কারণ জানতে চাইলে মামুন হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আন্তরিকতা। আমার আন্তরিকতা আছে, চেষ্টা আছে মানুষকে ভালো খাওয়ানোর। বাকি আল্লাহ আমাকে নাম দিয়েছেন, মানুষ আমাকে গ্রহণ করে নিয়েছে এটাই জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ।
তিনি বলেন, রাস্তার পাশে ভ্রাম্যমাণ দোকান করা কঠিন কাজ। সামনে দিয়ে সব সময় যানবাহন যেতে থাকে। এরপর পেছনে শো-রুম হওয়ায় সেদিকেও বেশি ভিড় করা যায় না। এজন্য আমার ভবিষ্যত চিন্তা একটি স্থায়ী দোকান নিয়ে এই ব্যবসা আরও বড় পরিসরে করবো। মানুষ যদি এভাবে আমাকে গ্রহণ করে এবং আমার খাবার পছন্দ করে তাহলে আমার এই স্বপ্ন পূরণ কঠিন হবে না।
মামুন হোসেন বলেন, বিকেল ৫টা থেকে রাত ৯টা এই ৪ ঘণ্টায় প্রতিদিন অন্তত ৩০-৩২ হাজার টাকার চটপটি বিক্রি হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন লাভ থাকে ৩ হাজার টাকার মতো। মাসে ৯০ হাজারের বেশি টাকা আয় হয়। সব মিলিয়ে আল্লাহ আমাকে আর্থিকভাবে সচ্ছল রেখেছেন।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: