লবণাক্ত মাটিতে চাষযোগ্য গমের জাত উদ্ভাবন গাকৃবির
প্রকাশিত:
২ জুলাই ২০২৫ ১৭:৪৩
আপডেট:
৩ জুলাই ২০২৫ ০৭:২৮

গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (গাকৃবি) কৃষিতত্ত্ব বিভাগ উচ্চ লবণ সহিষ্ণু গমের একটি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছে। এই বিভাগের প্রখ্যাত দুই কৃষি বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এম. ময়নুল হক এবং প্রফেসর ড. মো. মসিউল ইসলামের নেতৃত্বে সফল গবেষণার মাধ্যমে সম্প্রতি উদ্ভাবিত হয়েছে গমের নতুন জাত ‘জিএইউ গম ১’।
উচ্চ লবণাক্ততা (১২ ডিএস/মি) সহনশীলতার দিক থেকে এটি দেশের প্রথম উদ্ভাবিত জাত, যা একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিশেষত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জন্য অত্যন্ত উপযোগী এই প্রিমিয়াম কোয়ালিটির জাতটি লবণাক্ততা সহনশীল, উচ্চ ফলনশীল এবং অধিক প্রোটিনসমৃদ্ধ।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গাকৃবির গবেষণা মাঠে দীর্ঘদিন গবেষণা ও ফলন পরীক্ষার পর ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকদের মাঠে এই জাতটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এতে এটি লবণাক্ততা সহনশীল এবং উচ্চ ফলনশীল হিসেবে প্রমাণিত হয়। পরে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির সার্বিক তত্ত্বাবধানে দেশের ছয়টি স্থানে মাঠ মূল্যায়নে প্রস্তাবিত ফলন পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফলাফলের ভিত্তিতে জাতীয় বীজ বোর্ড ২০২৫ সালের ১৭ জুন গমের এই নতুন জাতটিকে অনুমোদন দেয়।
এই গমে বিদ্যমান উচ্চ প্রোটিন শরীর গঠন ও মেরামত, শক্তি সরবরাহ, রোগ প্রতিরোধে সহায়তা এবং ইমিউন সিস্টেম সক্রিয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, পর্যাপ্ত গ্লুটেনিন থাকায় এটি উচ্চ প্রোটিন ও কম ফ্যাটযুক্ত, ফলে সহজেই দেহে শোষিত হয়।
ডিইউএস-এর ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যবিশিষ্ট ল্যাব পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এই জাতটি সাধারণ গম থেকে গুণে-মানের দিক দিয়ে আলাদা। ‘জিএইউ গম ১’-এর দানা তামাটে, চকচকে এবং তুলনামূলকভাবে কম সময়ে পরিপক্ব হয়। আমন মৌসুমে ধান কাটার পর বপন করলে এটি ৯৫ থেকে ১০০ দিনের মধ্যেই ফসল ফলায়, ফলে কৃষকরা অল্প সময়ে অধিক ফলন পেয়ে লাভবান হতে পারেন।
এছাড়া, গাছের আকার বড়, কান্ড মোটা এবং গুটির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এ জাত থেকে অধিক পরিমাণ খড় পাওয়া যায়, যা গবাদিপশুর খাদ্য চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
উৎকৃষ্টমানের এ জাতের ফলন হেক্টরপ্রতি সাধারণ মাটিতে ৪ দশমিক ৫ টন এবং লবণাক্ত মাটিতে ৩ দশমিক ৭৫ টন পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব, যা একে অন্যান্য জাতের চেয়ে বিশেষ অবস্থানে নিয়ে গেছে।
উন্নত ইনব্রেড এই জাতটি বিভিন্ন রোগ যেমন ব্লাস্ট, রস্ট ইত্যাদির বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষম হওয়ায় সাধারণ জাতের তুলনায় গড়ে ১০–১৫ শতাংশ বেশি ফলন দিতে সক্ষম। এ জাতটি লবণ সহনশীল হওয়ায় মানবদেহে সোডিয়াম ক্লোরাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং পানি ও পুষ্টি শোষণে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
জলবায়ু সহনশীলতা এবং রোগ-পোকা প্রতিরোধক্ষমতার কারণে এটি দেশের বৈচিত্র্যময় পরিবেশে চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী ও লাভজনক এক জাত।
এ বিষয়ে অন্যতম উদ্ভাবক প্রফেসর ড. মো. মসিউল ইসলাম বলেন, ‘জিএইউ গম ১’ আমাদের দীর্ঘদিনের গবেষণা, মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অভিজ্ঞতার ফসল। দেশের উপকূলীয় ও লবণাক্ত এলাকায় ফসল উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে আমরা এই জাত উদ্ভাবনে কাজ করেছি। এটি লবণাক্ত পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে এবং অধিক ফলন দেয়—যা কৃষকদের জন্য লাভজনক, এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশা করি, ‘জিএইউ গম ১’ দ্রুত মাঠপর্যায়ে বিস্তার লাভ করবে এবং দেশের বিভিন্ন লবণাক্ত অঞ্চলে গম চাষে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। এ অর্জনকে আমরা কৃষকের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে বিবেচনা করছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. জিকেএম মোস্তাফিজুর রহমান নতুন জাত উদ্ভাবনের এ অসাধারণ সাফল্যে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, ‘জিএইউ গম ১ শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, বরং বাংলাদেশের কৃষিখাতের জন্য এক বড় অর্জন। উপকূলীয় অঞ্চল ও লবণাক্ত মাটিতে কৃষি উৎপাদন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে থাকে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের গবেষকদ্বয় নিরলস পরিশ্রম করে এমন একটি জাত উদ্ভাবন করেছেন, যা লবণাক্ত পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে এবং উচ্চ ফলন দিতে সক্ষম।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন এই জাতটিকে দেশের টেকসই কৃষির প্রতীক বলা যায়। এর মাধ্যমে কৃষকরা আগের তুলনায় আরও বেশি লাভবান হবেন এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পথে আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে যাব।’
ডিএম /সীমা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: