বিপর্যস্ত উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাখাত, ২ বছরে ঝরেছে ৬ লাখ শিক্ষার্থী
প্রকাশিত:
১৪ জুন ২০২৫ ১৩:০২
আপডেট:
১৫ জুন ২০২৫ ০৩:০৯

দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া এখন একটি বড় জাতীয় উদ্বেগে রূপ নিয়েছে। ২০২৩ সালে এসএসসি পাস করা ১৬ লাখ ৪১ হাজার ১৪০ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৬ লাখ শিক্ষার্থী ২০২৫ সালের এইচএসসি (২৬ জুন থেকে শুরু) পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না, যা মোট উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর প্রায় ৩৬ শতাংশ। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই প্রবণতা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন, দক্ষ জনশক্তি তৈরির লক্ষ্যে এবং উচ্চশিক্ষার প্রবাহে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সম্প্রতি আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির হালনাগাদ তথ্যে দেখা গেছে, এসএসসি পাসের পর ১৪ লাখ ৮৩ হাজার ৮৮৯ জন শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেছে। বাকি ১ লাখ ৫৭ হাজার ২৫১ জন শিক্ষার্থী একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি না হয়ে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়েছে, যা ভর্তি পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার প্রায় ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
এর পরের ধাপে আরও উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। দেখা গেছে, একাদশ শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেও চূড়ান্ত এইচএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ করেনি ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৩০৪ জন শিক্ষার্থী, যা প্রায় ২১ দশমিক ২ শতাংশ। সব মিলিয়ে দুই বছরে ঝরে পড়েছে ৫ লাখ ৯০ হাজার ৭৫৫ জন শিক্ষার্থী, যা মোট এসএসসি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর ৩৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
শিক্ষা বিশ্লেষকরা এটিকে একটি ভয়াবহ সংকেত হিসেবে দেখছেন, যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গন্তব্য ও জাতির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন লক্ষ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ বলেও মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, বোর্ডভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কারিগরি বোর্ডে রেজিস্ট্রেশন করেছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬৩ জন, কিন্তু পরীক্ষার জন্য ফরম পূরণ করেছে মাত্র ৯৫ হাজার ৪৩৮ জন। অর্থাৎ ৬৩ হাজার ৫২৫ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে না, যা ঝরে পড়ার হার হিসেবে দাঁড়ায় ৩৯.৯৬ শতাংশ। মাদ্রাসা বোর্ডে রেজিস্ট্রেশন করা ১ লাখ ২৮ হাজার ৭৫৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ফরম পূরণ করেছে ৭৯ হাজার ৯ জন। ফলে ৪৯ হাজার ৭৫০ জন বাদ পড়েছে, অর্থাৎ সেখানে ঝরে পড়ার হার ৩৮.৬৪ শতাংশ।
আবার সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে এ হার তুলনামূলকভাবে কম হলেও তা ১৫.৯৪ শতাংশ, যা মোটেই সামান্য নয়। ঢাকা বোর্ডে ৭৮ হাজার ৬৭৩ জন, রাজশাহী বোর্ডে ৬১ হাজার ২৫৭ জন, কুমিল্লায় ৪৪ হাজার ১১৬ জন, যশোরে ৩৭ হাজার ৯৫৯ জন, চট্টগ্রামে ২৮ হাজার ৩৭৪ জন এবং অন্যান্য সাধারণ বোর্ডেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।
মেয়েদের পাশাপাশি ঝরে পড়ছে ছেলেরাও
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মেয়েদের ঝরে পড়া দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত হলেও সাম্প্রতিক তথ্য বলছে—এখন ছেলেদের ঝরে পড়ার হারও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তথ্য বলছে, ঝরে পড়ার পেছনে নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্য, বাল্যবিয়ে, কর্মজীবনে আগমন, পারিবারিক বাধ্যবাধকতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি—এসব নানা কারণে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়ছে। আবার অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী এসএসসি পাস করার পর বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হচ্ছে। শুধু মেয়েরাই নয়, সাম্প্রতিক তথ্য বলছে—অনেক ছেলেও এসএসসি পাস করেই সংসারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে পড়ালেখা বন্ধ করে দিচ্ছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ড. খন্দোকার এহসানুল কবির জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। তার ভাষায়, বাল্যবিয়ে এবং কর্মজীবনে প্রবেশের কারণেই সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী উচ্চমাধ্যমিকে পৌঁছাতে পারছে না। পাশাপাশি, কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের যুক্ত হওয়াও উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার বলেন, এতদিন মেয়েদের ঝরে পড়া বেশি থাকলেও বর্তমানে ছেলেদের সংখ্যাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এমন পরিস্থিতির উত্তরণে প্রয়োজন দ্রুত পদক্ষেপ।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের এত বড় অংশের ঝরে পড়া আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গভীর সংকেত বহন করে। কেবল পরীক্ষার্থীর সংখ্যা নয়, ভবিষ্যতের দক্ষ জনশক্তির সংকটেরও পূর্বাভাস দিচ্ছে এটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও সমাজ গবেষক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, শিক্ষার্থীদের ক্রমাগত ঝরে পড়ার পেছনে কারিকুলামের অস্থিরতা ও কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষার অভাব প্রধান ভূমিকা রাখছে। তার ভাষায়, বারবার পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের ফলে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা আস্থাহীনতায় ভুগছেন। তারা মনে করেন, এই শিক্ষায় ভবিষ্যৎ গড়া যাবে না। এতে করে শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ কমছে, যার ফলাফল হচ্ছে শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে পড়া।
তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতাও শিক্ষার্থীদের বই থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়েছে। শিক্ষকরা এখন আর শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সমস্যায় কান দিচ্ছেন না, বরং প্রশাসনিক কাজ বা আর্থিক সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
চলতি বছরের যে চিত্র
এদিকে, চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ৮১ হাজার ৮৮২ জন কমে গেছে। গত বছর অংশ নিয়েছিল ১৩ লাখ ৩২ হাজার ৯৯৩ জন পরীক্ষার্থী। চলতি বছর অংশ নিচ্ছে ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৬ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন এবং ছাত্রী ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬ জন।
জানা গেছে, এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অনিয়মিত পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২ লাখ। এদের মধ্যে ২০২৪ সালের পরীক্ষায় একাধিক বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়া শিক্ষার্থী আছেন ১ লাখ ৯৭ হাজার জন। মানোন্নয়ন বা পুনঃপরীক্ষার জন্য অংশ নিচ্ছেন আরও প্রায় তিন হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। এসব শিক্ষার্থীর কেউ একজন এক বিষয়ে, কেউবা সব বিষয়ে পুনরায় পরীক্ষা দেবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্রী, যিনি ২০২৩ সালে এসএসসি পাস করলেও বর্তমানে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন না। তিনি জানান, এসএসসির পর বাবা-মা চাইলেও আর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিনি। আত্মীয়স্বজনের চাপ আর পরিবারের আর্থিক টানাপোড়েনের কারণে বিয়ে হয়ে গেছে। পড়তে ইচ্ছা ছিল, কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি।
ঢাকার একটি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। করোনার সময় থেকেই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ কমে গেছে। পরে একটা দোকানে কাজ শুরু করি। আর পড়াশোনায় নিয়মিত হতে পারিনি।
আবার অনেকেই বলছেন, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক সংকট, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কিংবা মানসিক অস্থিরতার কারণে পড়াশোনা থেমে গেলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই সময়মতো কোনো সহযোগিতা বা সহানুভূতিশীল সহায়তা পাননি। স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক, সমাজ বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এমন সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় অসংখ্য শিক্ষার্থী ধীরে ধীরে শিক্ষা থেকে ছিটকে পড়েছে। এমন অবস্থায় শুধুমাত্র নীতিগত উদ্যোগই নয় বরং মাঠপর্যায়ে সক্রিয় সহায়তা ও শিক্ষকদের দায়িত্বশীল আচরণ প্রয়োজন বলেও অভিমত অনেক শিক্ষার্থীদের।
বিষয়টি নিয়ে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক একেএম ইলিয়াস বলেন, শিক্ষার্থীদের উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়ার এই চিত্র নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। তবে আমরা এই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে চাই সমস্যা নয়, সম্ভাবনা হিসেবে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে—দারিদ্র্য, পারিবারিক সংকট, ডিজিটাল আসক্তি কিংবা সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা—সবকিছুই শিক্ষাজীবনকে প্রভাবিত করছে। তাই আমাদের দায়িত্ব শুধু শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নয়, বরং শিক্ষার্থীর সামগ্রিক মানসিক ও সামাজিক সুরক্ষাকেও গুরুত্ব দেওয়া।
তিনি আরও বলেন, আমরা ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে কাউন্সেলিং ব্যবস্থা জোরদার করেছি। শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যে নিয়মিত সংযোগ তৈরি করা, ক্লাসে উপস্থিতি মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, একেকজন শিক্ষার্থীর পেছনে রয়েছে একটি পরিবার, একটি সম্ভাবনা—এই ধারণা থেকেই কাজ করতে হবে।
অধ্যক্ষ ইলিয়াস মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যদি আরও মানবিক ও দায়িত্বশীল হয়, তাহলে অনেক শিক্ষার্থীকে শিক্ষার ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি, সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও অভিভাবকদের সমন্বিত উদ্যোগও প্রয়োজন। কেবল পাঠ্যবই নয়, শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ও স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখাটাই আজ সবচেয়ে জরুরি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: