ইরান-ইসরাইল সংঘাতের সম্ভাব্য পরিণতি কী হবে পারে?
প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২৫ ১৬:১৫
আপডেট:
১৬ জুন ২০২৫ ০৪:৩৮

মধ্যপ্রাচ্যের দুই চিরবৈরী শক্তি ইরান ও দখলদার ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের মধ্যে সম্প্রতি সরাসরি সামরিক সংঘাতের ঘটনা বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে ইসরাইলি হামলার পর ইরানের সরাসরি প্রতিশোধমূলক হামলা এবং ইসরাইলের পাল্টা আঘাত, পরিস্থিতিকে প্রক্সি যুদ্ধ থেকে সরাসরি সামরিক সংঘাতে রূপ দিয়েছে। এই সংঘাতের সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে, তা নিয়ে চলছে গভীর বিশ্লেষণ।
সংঘর্ষ বেঁধে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা
ইরানের দৃঢ় বিশ্বাস, মার্কিন মদদেই হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। ওদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, তাদের কাছে হামলার বিষয়ে খবর ছিল। সে জন্যই বোধহয়, বিগত কয়েকদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কর্মী সরিয়ে নিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
চলমান সংঘাত নিয়ন্ত্রণ হারালে ইরাক, গালফসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন ঘাঁটি ও কূটনৈতিক মিশনে হামলা চালিয়ে বসতে পারে তেহরান। তাদের মদদপুষ্ট আঞ্চলিক সশস্ত্র বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এ কাজে তাদের সহায়তাও করতে পারে।
ট্রাম্প যদিও বারবার বলে আসছেন, তিনি কোনও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়াতে চান না, কিন্তু ইসরায়েল বা মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও কোনও মার্কিনি নাগরিক ইরানি হামলায় মারা গেলে, তিনি হয়ত সামরিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবেন।
আর মার্কিন বাহিনী যদি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তবে আমরা হয়ত ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো আরেকটা বহুবছরব্যাপী সংঘর্ষ দেখব, যা পুরো একটি রাষ্ট্রকে পুরো ধ্বংস করে দিতে পারে।
আঞ্চলিক সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরাইলের সরাসরি সংঘাত আঞ্চলিক অস্থিরতাকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী, ইরাক ও সিরিয়ায় ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরও সক্রিয় হতে পারে। এর ফলে একটি বিস্তৃত আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, যা সিরিয়া, লেবানন, ইরাক এবং ইয়েমেনের মতো দেশগুলোকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। উপসাগরীয় দেশগুলো, যেমন সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত, যারা উভয় দেশের সঙ্গেই সতর্ক সম্পর্ক বজায় রাখে, তারাও নতুন করে চাপে পড়বে।
বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা
ইরান বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ। হরমুজ প্রণালী, যা বিশ্বজুড়ে তেলের একটি বড় অংশ পরিবহনের মূল পথ, ইরানের নিয়ন্ত্রণে। যদি সংঘাত তীব্র হয় এবং ইরান এই প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তবে বিশ্বব্যাপী তেলের সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং তেলের দাম আকাশচুম্বী হতে পারে। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দা এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে।
পারমাণবিক ঝুঁকি বৃদ্ধি
ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। ইসফাহানে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরাইলের হামলা এই ঝুঁকির মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। যদি ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে বড় ধরনের হামলা চালায়, তাহলে ইরান তার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টাকে আরও দ্রুত এগিয়ে নিতে পারে, যা আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ইসরাইলের ব্যর্থ হামলা ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে আরও উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
আন্তর্জাতিক জোটের মেরুকরণ
এই সংঘাত আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে আরও স্পষ্টভাবে দুটি শিবিরে বিভক্ত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা সাধারণত ইসরাইলের পক্ষ নেয়, যদিও তারা উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানাচ্ছে। অন্যদিকে, চীন ও রাশিয়া, যারা ইরানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক বজায় রাখে, তারা পরিস্থিতিকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করতে পারে। এই মেরুকরণ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদসহ আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
বৈশ্বিক বাণিজ্য ও সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র। সংঘাতের ফলে বিমান চলাচলের রুট পরিবর্তন করতে হতে পারে, যা ফ্লাইট বিলম্বিত করবে এবং খরচ বাড়াবে। সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে, যা বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে এবং পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পাবে।
সাইবার যুদ্ধ
ইরান ও ইসরাইল উভয় দেশেরই শক্তিশালী সাইবার সক্ষমতা রয়েছে। সংঘাতের তীব্রতা বাড়লে একে অপরের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে সাইবার হামলা চালানোর সম্ভাবনা রয়েছে, যা বিদ্যুৎ গ্রিড, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং আর্থিক খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
ইরানে ইসলামিক শাসনের অবসান এবং রাজনৈতিক শূন্যতা
ইসরাইল যদি কৌশলগতভাবে সফল হয় এবং ইরানের ইসলামি বিপ্লবী সরকারকে উৎখাতে বাধ্য করতে পারে, তবে সেই শূন্যতা ভরাট করতে গিয়ে দেখা দিতে পারে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা। ইসরাইল যতই বলুক, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা সীমিত করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য, নেতানিয়াহুর ভাষণে তাদের দীর্ঘমেয়াদি আকাঙ্ক্ষার আভাস টের পাওয়া গেছে।
হামলার পর ধারণকৃত এক ভিডিও বার্তা প্রচার করে ইসরাইল। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইরানি জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে সেখানে বলেছেন, তাদের হামলার কারণে ইরানিদের পথ কণ্টকমুক্ত হচ্ছে, যেন তারা শোষকগোষ্ঠীকে উৎখাত করতে পারে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে, উভয় পক্ষের অনড় অবস্থান এবং প্রতিশোধের প্রবণতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। যদি কূটনৈতিক সমাধান দ্রুত না হয় এবং উভয় পক্ষ সংযম প্রদর্শন না করে, তবে মধ্যপ্রাচ্যের এই আগুন শুধু আঞ্চলিক নয়, বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এক ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: