অনলাইনে জুয়া: সাজার পরিমাণের চেয়ে আইন কার্যকরে জোর
প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২৫ ১৮:৩৫
আপডেট:
১৬ জুন ২০২৫ ০৪:২৪

বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার গত মাসে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করেছে। সেখানে সাইবার স্পেসে জুয়া খেলা এবং জুয়ার বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া বন্ধ হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, কোনো অপরাধ বন্ধের বিষয়টি সাজার পরিমাণ বাড়ানো বা কমানোর ওপর নির্ভর করে না। মূল বিষয় হচ্ছে আইনে যথাযথ কার্যকর এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। তাদের মতে আইনে সাজা যতটুকু থাকুক না কেন সেটি ইমপ্লিমেন্ট বা কার্যকর করলে অপরাধ কমে যাবে।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মনজিল মোরশেদ বলেন, ‘অনলাইনে জুয়ার যে বিজ্ঞাপনের সাথে জড়িত অনেক প্রভাবশালী। এজন্য এ বিজ্ঞাপন বা এই জুয়াসংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। তবে আমাদের সংবিধানে জুয়ার বিষয়ে শাস্তির বিধান করা হয়েছে। পাশাপাশি আলাদা আইনও করা হয়েছে। এই আইনের যে সাজার কথাই বলা হোক না কেন সাজা যদি কার্যকর করা হয় তাহলে এই অপরাধটি অনেকাংশেই কমে যাবে।’
সিনিয়র এই আইনজীবী বলেন, ‘ইতোপূর্ব আমি আমার সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি মামলা করেছিলাম এবং সে সময়ের একজন মন্ত্রীকে ফোন দিয়েছিলাম। তাকে জুয়া বন্ধের ব্যবস্থা নিতে বলেছিলাম। কিন্তু তিনি আর শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা নিতে পারেননি। কারণ এর পেছনে অনেক প্রভাবশালী জড়িত আছেন। আমি বলব, জুয়ার বিষয়ে আইন হওয়া এবং যতটুকু শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা যদি ইমপ্লিমেন্ট বা কার্যকর করা হয় তাহলে এ অপরাধটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।’
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি ও সিনিয়র আইনজীবী এ বি এম আলতাফ হোসেন বলেন, ‘ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। কোনো অপরাধের সাজা কম বা বেশি সেটি ভিন্ন বিষয়। সাজার পরিমাণ যদি যাবজ্জীবন করা হয় আর যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত না হয় তাহলেও কিন্তু অপরাধ কমবে না। মূল বিষয় হচ্ছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। সঠিক বিচার করা তাহলেই অপরাধ অনেকটাই কমে আসবে।’
কী বলা হয়েছে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে
অনলাইনে জুয়ার বিষয়ে বলা হয়েছে, যেসব ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ সংঘটন করবে তিনি দুই বছর কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এছাড়া সাইবার স্পেসে নগ্ন ছবি চেয়ে হয়রানি করা এবং প্রশাসনিক অথবা পেশাগত ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়াকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে।
কোনো ব্যক্তির অনুমতি ব্যতীত তার ক্ষতিসাধনের উদ্দেশে উক্ত ব্যক্তির অন্তরঙ্গ অথবা ব্যক্তিগত ছবি, ভিডিও অথবা অনুরূপ উপাত্ত যেকোনো প্রকার প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছড়িয়ে দেওয়াকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে এই অধ্যাদেশে। গত ২১ মে এ সংক্রান্ত গেজেট জারি করেছে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
অধ্যাদেশে সাইবার স্পেসে প্রতারণা, সন্ত্রাসী কার্য সংঘটন, আইনানুগ কর্তৃত্ব বহির্ভূত ই-ট্রানজেকশনকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করেন এবং জনগণ বা উহার কোনো অংশের মধ্যে ভয়ভীতি সঞ্চার করার অভিপ্রায়ে কোনো কম্পিউটার বা ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে বৈধ প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন বা বেআইনি প্রবেশ করেন তা সাইবার সন্ত্রাসী কার্য হিসেবে গণ্য হবে। এ ধরনের অপরাধ সংঘটনের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি দশ বছর দণ্ড বা কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই অধ্যাদেশের অধীন কোনো অপরাধ কোম্পানি কর্তৃক সংঘটন হলে শুধু অর্থদণ্ড আরোপের বিধান রাখা হয়েছে।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি সাইবার স্পেসে জুয়া খেলার নিমিত্তে কোনো পোর্টাল, অ্যাপস বা ডিভাইস তৈরি বা পরিচালনা করেন; জুয়া খেলায় অংশগ্রহণ বা খেলায় সহায়তা বা উৎসাহ প্রদানের জন্য বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রচার করেন তাহলে তা হবে অপরাধ।
অধ্যাদেশে যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইলিং বা অশ্লীল বিষয়বস্তু প্রকাশ করাকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সাইবার স্পেসে ধর্মীয় বা জাতিগত বিষয়ে সহিংসতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক তথ্য প্রকাশকেও অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে দুই বছর কারাদণ্ড ও দশ লক্ষ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে।
তবে এই অধ্যাদেশে মিথ্যা মামলা দায়েরকারীকেও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির ক্ষতিসাধনের জন্য এই অধ্যাদেশের অধীন কোনো মামলা দায়ের করেন এবং তা মিথ্যা প্রমাণিত হলে মূল অপরাধটির জন্য যে দণ্ড নির্ধারিত সেই দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন। এই আইন বাতিল করে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। আইনটিকে বিরোধী মত প্রকাশের স্বাধীনতা দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরিচিতি পায় কালো আইন হিসেবে। এই আইন বাতিল করে ২০২৩ সালে করা হয় সাইবার নিরাপত্তা আইন। এসব আইনে দায়েরকৃত মামলায় তৎকালীন সরকারের আমলে বিরোধী মতাদর্শের অসংখ্য মানুষ গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তবর্তী সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সর্বশেষ সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি করে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: