রবিবার, ৩রা আগস্ট ২০২৫, ১৯শে শ্রাবণ ১৪৩২


শব্দ ও বায়ু দূষণে বিপন্ন জনজীবন


প্রকাশিত:
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৮:৩৫

আপডেট:
৩ আগস্ট ২০২৫ ১৩:১১

প্রতীকী ছবি

শব্দ ও বায়ু দূষণে রাজধানীর জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। গত কয়েক বছর যাবত শব্দ ও বায়ু দূষণের তালিকায় বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছে ঢাকা। রাস্তায় বেরুলেই হাজার হাজার গাড়ীর অযাচিত হর্ণ শুনতে হয় নগরবাসীকে। গাড়ীর চালকরা নিয়ম বহির্ভূতভাবে এক লেন ছেড়ে অন্য লেনে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে প্রতিনিয়তই। চালকরা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতেও কারনে-অকারনেই হর্ণ দিয়ে থাকে। এদিকে অতিরিক্ত হর্ণের প্রভাবে কান ও মস্তিস্কের নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।

এদিকে শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা শহরের বায়ু দূষণ বৃদ্ধি পায় কয়েকগুণ। তবে গবেষণা বলছে বছরের অন্য দিনগুলোর তুলনায় ৩১ ডিসেম্বর রাতে ঢাকা শহর বায়ু ও শব্দ দূষণে সব রেকর্ড অতিক্রম করে।

বিগত চার বছর ধরে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বায়ু ও শব্দদূষণ পরিমাপ করে এই তথ্য জানিয়েছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ণ কেন্দ্র (ক্যাপস)। গবেষণাটিতে জানানো হয়, ২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর ও পহেলা জানুয়ারি দু’দিনের শব্দ ও বায়ুমান পর্যবেক্ষণ করে আসছে ক্যাপস। এতে দেখা যায় ৩১ ডিসেম্বরের তুলনায় নতুন ১ জানুয়ারি ঢাকার বায়ু ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত বেশি দূষিত থাকে। এই সময় বায়ুমান পৌঁছায় ৫০০ একিউআই পর্যন্ত। যা মানুষের সহ্য ক্ষমতার তুলনায় ৯ গুণ বেশি। একই চিত্র দেখা যায় শব্দের ক্ষেত্রেও। চার বছর ধরে ৩০ ডিসেম্বর রাতের সঙ্গে ৩১ ডিসেম্বর রাতের শব্দমান তুলনা করেন তাঁরা। এতে ৩০ ডিসেম্বর রাত ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত যেখানে শব্দমান ৩০ ডেসিবেল পর্যন্ত পাওয়া যায় সেখানে ৩১ ডিসেম্বর একই সময়ে পাওয়া যায় ১১০ ডেসিবেল পর্যন্ত। যা একজন মানুষকে বধির করে দেওয়ার শক্তি রাখে।

এ বিষয়ে বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ণ কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রধান ও বায়ুমান বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, অতিরিক্ত বায়ু দূষণ সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে ফুসফুসে সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত শব্দ দূষণে বধিরও হতে পারে মানুষ। মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতির বিবেচনায় দিবস উদযাপনকেন্দ্রীক শব্দ ও বায়ুদূষণকারী বাজি ফুটানো, ফানুস ওড়ানো বন্ধের দাবি জানান এই পরিবেশবিজ্ঞানী। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে পরিবেশ অধিদফতর। যার পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন সংস্থাটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক হুমায়ুন কবির। জনগণকে নিয়ে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ এই প্রকল্পের মূল কাজ হলেও এই দিবসে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি তাদের।

বেসরকারি সংস্থা ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়ামের গবেষণায় জানা যায়, ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ঢাকা শহরের নির্বাচিত ১০টি এলাকা থেকে শব্দ ও বায়ু মানের নমুনা সংগ্রহ করে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদীর ডায়িং, নৌযান ও ট্যানারি দূষণের চারটি এলাকা থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেন গবেষক দল। একই সঙ্গে গবেষণায় নদীপারের সাধারণ মানুষ ও নাগরিক সমাজের মতামত গ্রহণ ছাড়াও এ সংক্রান্ত নীতি, আইন ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পর্যালোচনা করা হয়েছে। কর্মশালায় গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, ৪৮ দিন ছাড়া বছরের বাকি সময় ঢাকার বাতাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) করা নির্মল বায়ুর মানমাত্রার চেয়ে খারাপ থাকে। মূলত বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণকাজের ধুলা, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির ধোঁয়া, ইটভাটাসহ শিল্পকারখানার ধোঁয়া থেকে এই দূষণ হয়।

স্টামফোর্ড বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘বায়ুদূষণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনুধাবন করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে বস্তুকণা ২.৫ এর মানমাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম থেকে কমিয়ে ৫ মাইক্রোগ্রাম করেছে, সেখানে সাম্প্রতিক পাস হওয়া বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২ এর ১ নম্বর তফসিলে বায়ুর মানমাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে বাড়িয়ে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, অপরদিকে একই বিধিমালার তফসিল ৫-এ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্ট্যাক নিসঃসরণের সর্বোচ্চ সীমা সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন এর অক্সাইডসমূহ এবং বস্তুকণার মানমাত্রা যথাক্রমে ঘনমিটারে ২০০, ২০০ এবং ৫০ মিলিগ্রাম করা হয়েছে, যা উন্নতদেশের মানমাত্রার চেয়ে নূন্যতম ৪-৫ গুণ বেশি। অর্থাৎ উন্নত দেশগুলো তাদের দেশে উন্নয়ন কর্মকান্ড করার সময় নিঃসরণ মাত্রার যে মানদন্ড মেনে চলে, সেই মানমাত্রা দেশগুলো উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আমাদের দেশে কাজ করার সময় মানে না। আমাদের দেশে যে মেগাপ্রজেক্ট হচ্ছে তার ‘হেলথ ইমপ্যাক্ট’ বিবেচনায় অর্থনৈতিক মূল্য নিরূপণ করা দরকার বলে মনে করেন ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশ’র সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি এ সময় পরিবেশসম্মত হয় না এমন প্রজেক্ট বাতিল করা উচিত বলে মন্তব্য করেন।

সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’র প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ‘বায়ুমান নিয়ন্ত্রণের জন্য আমাদের জীবাশ্ম জালানিভিত্তিক উৎপাদন থেকে পর্যায়ক্রমে সরে আসতে হবে। বছরে ৩১৭ দিন মারাত্মক দূষিত থাকে ঢাকার বায়ু। এক গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শীতকালে ঢাকার বাতাস ১৬ গুণ বেশি দূষিত থাকছে।

দূষণের মানমাত্রা বিবেচনায় বছরের বেশির ভাগ সময় ‘অস্বাস্থ্যকর’ থাকে রাজধানী ঢাকার বাতাস। মাঝেমধ্যে এটা ‘বিপজ্জনক’ পর্যায়ে গিয়েও ঠেকে। বিশেষত শীতকালে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি থাকে সবচেয়ে খারাপ। ৪৮ দিন ছাড়া বছরের বাকি সময় (৩১৭ দিন) ঢাকার বাতাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্মল বায়ুর মানমাত্রার চেয়ে খারাপ থাকে। এক গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শীতকালে ঢাকার বাতাস ১৬ গুণ বেশি দূষিত থাকছে।

ঢাকা শহরের পানি, বায়ু ও শব্দদূষণবিষয়ক পরিবীক্ষণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গবেষণাটি করা হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, কোভিড-১৯ এ আমাদের দেশে এ পর্যন্ত যে সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে, শব্দ ও বায়ুদূষণে প্রতি বছরই তা হচ্ছে। সব দূষণ বিবেচনায় বায়ূ দূষণের প্রভাব তিন গুণ বেশি। তাই জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় সব উন্নয়ন হওয়া জরুরি।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, নদী, পানি, পরিবেশ ও শব্দ দূষণ নিয়ে দেশে আইন আছে। তবে এসব আইনের প্রয়োগ নেই, প্রয়োগ করার মানুষ নেই। আর মানুষ থাকলেও তাঁদের আইন প্রয়োগ করার সে সাহস নেই। প্রতিটি বিভাগের জবাবদিহির জায়গা নিশ্চিত করতে হবে, তাহলে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top