বৃহঃস্পতিবার, ২৫শে এপ্রিল ২০২৪, ১২ই বৈশাখ ১৪৩১


জনস্বার্থের সাংবাদিকতা ও স্বাধীনতার মর্যাদা


প্রকাশিত:
১ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:২১

আপডেট:
২৫ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:৪৬

 ফাইল ছবি

স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করা কি কোনো ধর্ম? স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কি কোনো কথা বলা যাবে না? বিশেষ করে দরিদ্র, যে ‘ভাত’ পায় না—সে তো বলবেই! এবং গণমাধ্যম তা প্রকাশ করবেই! একজন সিনিয়র সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই প্রশ্ন তুলেছেন।

প্রশ্ন তুলেছেন কারণ, সাংবাদিকতার সীমানা নিয়ে তার ধারণা এক রকম, আবার এই বিষয়ে বিভিন্ন সাংবাদিক মোর্চার বিবৃতি প্রতিক্রিয়া বলছে তাদের ধারণা আরেক রকম।

বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সব মত-তথ্য আমরা গণমাধ্যমে কেন প্রকাশ করতে পারি না? তার সঙ্গে স্বাধীনতার মর্যাদা কোথায়? এবং পুরো সাংবাদিকতার রীতিনীতি আচরণবিধি এবং স্বীকৃত ব্যাখ্যা কীভাবে আমরা সংরক্ষণ এবং চর্চা করতে পারব?

সাংবাদিকতার সর্বশেষ ধারণা হলো, পাবলিক ইন্টারেস্ট জার্নালিজম বা জনস্বার্থ। এর মৌলিক অবস্থান হলো ‘জনস্বার্থ’—কেবল জন-আগ্রহ প্রশমন নয়। এবং এখানে স্বার্থ মানে কেবল ব্যক্তিস্বার্থ নয়—যে স্বার্থ মূলত নির্দিষ্ট ভূখণ্ড সমাজের বৃহত্তর মানুষের স্বার্থ রক্ষা করে তাই—জনস্বার্থ।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। করোনায় লক্ষ মানুষ ঈদে বাড়ি ফিরতে চেয়েছে। এটি জন-আগ্রহ! কিন্তু মায়ের সঙ্গে ঈদ করার যে জন-আবেগ তার ফলাফল হিসেবে মা বাবা করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন—মারাও যেতে পারেন—করোনা আরও ছড়িয়ে যেতে পারে!

এই যে জনস্বার্থ রক্ষা করার ধারণা এটিই সাংবাদিকতার লক্ষ্য এবং ধারণা। একে ‘জনস্বার্থ সাংবাদিকতা’ নাম দেওয়া হলেও আদি ধারণাতেও তাই আছে! যার আরও খুঁটি শব্দ—রেসপন্সিবিলিটি বা দায়িত্বশীলতা।

ফলে যা কিছু আমরা প্রকাশ করছি বৃহত্তর জনস্বার্থ তাতে উপকৃত হচ্ছে কি না; যেকোনো ‘সংবাদ’ এই বিবেচনায় প্রকাশ করা হলেই —সোশ্যাল মিডিয়ায় যা ইচ্ছা তাই প্রকাশের ধারণা থেকে সাংবাদিকতা একদম স্বতন্ত্র অবস্থান নেয়! কিন্তু কোনটি বৃহত্তর স্বার্থ? এবং এটি কে নির্ধারণ করবে?

এই দুটি প্রশ্ন ছাড়াও পুরো সংবাদ কাঠামোয় এমন অসংখ্য শাখা প্রশাখার প্রশ্ন আছে যার মীমাংসা কে করবে? আলাপটা এইখানে রেখে স্বাধীনতা দিবসে ‘ভাতের স্বাধীনতা’ প্রকাশের সাংবাদিকতার নীতির প্রসঙ্গটি বলি; তাহলে ‘শাখা প্রশাখার’ ধারণাও খানিকটা পরিষ্কার হওয়া যায়!

সাংবাদিকতার আরেকটা বড় পিলার সত্য উদঘাটন! যেটি যেকোনো অবাধ মতপ্রকাশের ধারণার সঙ্গে খানিকটা সাংঘর্ষিক।

বছরের যেকোনো দিনে ‘ভাতের স্বাধীনতা’ যদি কেউ চান—সেটি অবশ্যই প্রকাশ করবেন সাংবাদিক! এমনকি স্বাধীনতা দিবসেও করতে পারেন! কিন্তু সেক্ষেত্রে স্বাধীন হওয়ার ফলে দেশের মানুষের ভাতের চাহিদা কতটা পূরণ করেছে স্বাধীন বাংলাদেশে, সেই পুরো তথ্য, প্রতিবেদনে থাকতে হবে! না হলে সেটি হবে খণ্ডিত চিত্র অসত্য এবং মিসরিপ্রেজেন্টেশন বা ভুল উপস্থাপন।

এখন এই যে সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি উদ্দেশ্য এবং কোনটি সাংবাদিকতার স্বীকৃত ও আইনসম্মত ‘আচরণবিধি’—যা মূলত মীমাংসা করে সাংবাদিকতার সীমানা; বাংলাদেশে সেই আইনসম্মত কর্তৃপক্ষ প্রেস কাউন্সিল!

এই প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট যে আচরণবিধির ওপর দাঁড়ানো তার প্রথম লাইনে আছে—‘জাতিসত্তা বিনাশী এবং দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ও সংবিধান বিরোধী বা বিনাশী কোনো সংবাদ বা সংবাদ ভাষ্য প্রকাশ করা যাবে না’।

এই কারণেই ‘ভাতের স্বাধীনতার’ সংবাদ ছবিটি যদি স্বাধীনতার মর্যাদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় তাহলে আইন অনুযায়ী সেটি অপরাধ।

এখন আলোচিত প্রতিবেদন কতটা মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে; মূল ছবির হেডার সম্পাদিত হওয়ার কারণে আর অপরাধ বিবেচিত হবে কি না—সেটি অন্য বিস্তারিত আলাপ।

তবে, ধর্মীয় বিশ্বাসের মতো স্বাধীনতার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো প্রশ্ন কেউ তুলতে চাইলে সেটি তার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু এই প্রশ্নে উৎসাহিত হয়ে এবং স্বাধীনতার মর্যাদায় আঘাত তুলে কোনো সংবাদ প্রকাশের সুযোগ অন্তত আইন অনুযায়ী নেই! নতুন করে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ পরিবর্তন হলে সেটি নতুন বাস্তবতা!

কোনো জাতীয় স্বীকৃত আচরণবিধি ছাড়াও কেবল স্বাধীন সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হিসেবে যার যার সম্পাদকীয় নীতি দিয়ে পরিচালিত হতে পারে। সেটি আরেকটি স্বতন্ত্র ধারা! কিন্তু দিনশেষে সব গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের মৌলিক কিছু আচরণবিধি অনুসরণ করতেই হয়।

বলা জরুরি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল কেবল প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য প্রযোজ্য! অনলাইন কিংবা সম্প্রচার মাধ্যম এতে প্রযোজ্য নয়! অর্থাৎ বাংলাদেশে সব টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়া লাইসেন্স বা অনুমোদন পাওয়ার সময় কিছু শর্তাবলী ও নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

উল্লেখ্য, প্রেস কাউন্সিলের আচরণবিধিও অসম্পূর্ণ ও যুগোপযোগী নয়! অর্থাৎ বাংলাদেশের সব মিডিয়ার জন্য সর্বজনস্বীকৃত আচরণবিধি তৈরি করা এখন অতি জরুরি মৌলিক কাজ।

যে জায়গা আরও ভয়ানক তা হলো—প্রিন্ট সাংবাদিক বলতে পারবেন কোনো ব্যত্যয়ে তার বিচার প্রেস কাউন্সিলে হোক। কিন্তু অনলাইন ও সম্প্রচার সাংবাদিকের জন্য একটাই পথ—ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট! সরাসরি মামলা এবং গ্রেফতার! তাহলে কবে হবে আচরণবিধি, কবে উঠবে মামলার খড়্গ?

ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার—সম্প্রচার সাংবাদিকদের সংগঠন সম্প্রতি গণমাধ্যমকর্মী আইন নিয়ে অংশীজন সংলাপ করেছে! সেখানে এডিটরস গিল্ড সভাপতি মোজাম্মেল বাবু একটা প্রস্তাব দিয়েছেন; অন্যান্য সংশোধনসহ গণমাধ্যমকর্মী (নামটি সংশোধনেরও প্রস্তাব আছে) আইনের শুরুতেই বলা হোক সাংবাদিকের জন্য ডিএসএ প্রযোজ্য হবে না!

সরকার যেটি মৌখিক আশ্বাস দিয়েছেন, এর আগে সাংবাদিক সুরক্ষা আইন তৈরির পক্ষে কয়েকটি সাংবাদিক সংগঠন মত দিয়ে বলছে এটিও হতে পারে সুরক্ষা কবচ।

এদিকে ‘আচরণবিধি’ তৈরি করতে গিয়ে আবার স্বাধীন গণমাধ্যমের অধিকার সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে না তো? পুরো এশিয়ায় এর সর্বোচ্চ ভালো উদাহরণ ‘ইন্দোনেশিয়ান প্রেস কাউন্সিল’। এটি গঠিতই হয়েছে সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর ওপর যেন এর অধিকর্তারা স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

কোনো সংবাদে কেউ বিক্ষুব্ধ হলে সেখানেই বিচার প্রার্থনা করতে পারেন। মিডিয়া কোনো ভুল করলে কারও অধিকার হরণ করলে কীভাবে তা আবার মেনে নিয়ে প্রকাশ করবে তার সুনির্দিষ্ট পন্থা বলে দেওয়া আছে। আর এই পর্যন্ত পৌঁছাতে সাংবাদিকদের সঙ্গে বহু কর্মশালায় প্রস্তুত হয়েছে স্বীকৃত আচরণবিধি!

বলা হয়—ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে এই প্রেস কাউন্সিলের বড় অবদান রয়েছে। কারণ তথ্য প্রবাহ একটা দেশকে বিভক্ত কিংবা এক করে!

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে লম্বা সেই পথে সাংবাদিকদেরই হাঁটতে হবে! তবে তা হতে হবে যূথবদ্ধ কিন্তু স্বতন্ত্র!

শাকিল আহমেদ ।। বার্তা প্রধান, একাত্তর টিভি



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top