মঙ্গলবার, ২রা সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮ই ভাদ্র ১৪৩২


পাখি ডিম পাড়ায় বন্ধ স্টেডিয়াম, প্রকৃতি সংরক্ষণে আমরা কী ভাবছি?


প্রকাশিত:
২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:২৫

আপডেট:
২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৪:২৮

ছবি সংগৃহীত

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি ফুটবল স্টেডিয়ামে প্লোভার বা ল্যাপউইং পাখির ডিম দেওয়া এবং পরবর্তীতে স্টেডিয়ামটি এক মাসের জন্য বন্ধ ঘোষণা করার খবর মানুষের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছে। জানা যায় সংরক্ষিত প্রজাতির একটি দেশি পাখির প্রজনন যেন বিঘ্নিত না হয় তাই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

আমাদের জন্য এই ধরনের খবর কিছুটা কৌতূহলোদ্দীপকও বটে। একটা পাখির ডিমের জন্য বা প্রকৃতি সংরক্ষণে এই ধরনের সিদ্ধান্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

যদিও বিপন্ন প্রাণী সুরক্ষা এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পৃথিবীর অনেক দেশেই এরকম ঘটনা প্রায়শ দেখা যায়; এই যেমন আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের একটি হাই স্কুলের লাইট পোস্টে মাছমুড়াল (Osprey) পাখির একটি বাসা তৈরির কারণে রাত্রিকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ব্যাঘাত ঘটে।

স্কুল কর্তৃপক্ষকে পরবর্তীতে ফুটবল খেলার সময়সূচি পুনর্বিন্যাস করতে হয়েছিল—খেলার সূচি রাতের পরিবর্তে দিনে পরিবর্তন করা হয়েছিল, কারণ উজ্জ্বল ফ্লাডলাইট জ্বালালে পাখিগুলো পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি তৈরি হতে পারতো। উল্লেখ্য মাছমুড়াল সেদেশে একটি পরিযায়ী এবং সংরক্ষিত পাখি প্রজাতি।

২০১৯ সালে নিউ জার্সির একটি সকার মাঠ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল কিলডিয়ার (Killdeer) নামক একটি রক্ষিত পাখির জন্য। পাখিটি মাঠের ঠিক গোলপোস্টের কাছে বাসা বানায়। এই পাখিটি ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার ‘পরিযায়ী পাখি চুক্তি’র আওতাভুক্ত। ফলে পাখির যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য মাঠ কর্তৃপক্ষ তাদের পরবর্তী খেলাগুলো অন্যত্র স্থানান্তরিত করেন।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে একটি পার্ক বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং পার্কের মেইন গেইটে একটি সাইনবোর্ড ঝুলানো হয় ‘পাখিদের প্রজননের কারণে পার্ক বন্ধ’! এর কারণ হলো এই পার্কের গাছে গাছে বাসা করেছিলো গো-বকেরা (Cattle egrets)।

এই বক প্রজাতি সাধারণত দল বেঁধে বাসা তৈরি করে এবং এই ধরনের এক একটি প্রজনন স্থানকে কলোনি বলা হয়। এভাবে পাশাপাশি অবস্থান করে গো-বকেরা তাদের প্রজনন সম্পূর্ণ করে থাকে। এই পাখি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আইনে সংরক্ষিত এবং এদের কোনোরূপ ক্ষতি সাধিত হলে তা আইনত দণ্ডনীয় বলে বিবেচ্য হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যুক্তরাজ্যর ওয়েলস, হাল শহরেও এরকম কিছু ঘটনা ঘটে যেখানে জলচর পাখির প্রজননের জন্য বিনোদনের স্থান যেমন ওয়াটার পার্ক সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সাময়িক অসুবিধা হলেও উপরের ঘটনাগুলো সেইসব দেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেন কারণ তারা আইন এবং বন্যপ্রাণীর প্রতি সংবেদনশীল।

অনেকেই হয়তো জানেন না যে, আমাদের দেশের সুন্দরবনেও বছরের তিন মাস (জুন থেকে আগস্ট) স্থানীয় বনজীবী, মৎস্যজীবী বা সাধারণ পর্যটকদের জন্য প্রবেশে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকে। এই নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুমকে নির্বিঘ্ন রাখা এবং পরিবেশকে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া।

বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আমাদের আন্তরিকতাও কিন্তু কম নয়। ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওস এই কয়েকটা দেশে মহাবিপন্ন বাংলা শকুন (White-rumped vulture)-এর বসবাস ছিল। এক সময় সারা দেশে এর দেখা মিললেও এখন সুন্দরবন সংলগ্ন কিছু এলাকা এবং সিলেটের হবিগঞ্জে এদের দেখা মেলে।

তবে হবিগঞ্জের রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এখন বিপন্ন বাংলা শকুনের জন্য শেষ ভালো আবাসস্থল। এই বনে শকুনের প্রজনন ঋতুতে পশুর মাংস সরবরাহ করা হয় নিয়ম করে, যা বন বিভাগ এবং প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে।

এর ফলে এই বনে টিকে আছে আমাদের দেশের বেশিরভাগ বাংলা শকুনেরা। এই ধরনের কার্যক্রম দেশে দেশে পালন করা হয় যেন মানবসৃষ্ট কারণে বিপন্ন হওয়া পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়।

এদেশের অনেক প্রকৃতি সংরক্ষণবিদ মনে করেন, দেশের বেশকিছু জাতীয় উদ্যান এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলও বন্যপ্রাণীর নির্বিঘ্ন চলাচল বা প্রজননের জন্য বছরের নির্দিষ্ট কয়েকমাস নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা দরকার। যদিও শুধু আইন বা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে প্রকৃতি পরিবেশ বা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সম্ভব নয়।

আমরা শুধুমাত্র আমাদের প্রয়োজনে প্রাকৃতিক বনভূমি ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছি, ফলে বন্য প্রাণী ও পাখিদের স্বাভাবিক আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে। বন্য প্রাণীর সাথে মানুষের সংঘাতও দিন দিন বাড়ছে।

বন্য প্রাণীর আবাসস্থল সঙ্কুচিত হওয়ার কারণে বাধ্য হয়ে এরা লোকালয়, শহর বা মানুষের তৈরি স্থাপনা, মাঠ ও পার্কের মতো স্থানে বাসা বাঁধতে ও খাদ্য খুঁজতে বাধ্য হচ্ছে। তাই আমাদের উচিত সহনশীল হওয়া, তাদের আচরণকে বুঝে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজন হলে প্রাকৃতিক ও নিরাপদ বিকল্প আবাসস্থল তৈরি করা।

বিখ্যাত ব্রিটিশ সংরক্ষণবিদ জেন গুডল (Jane Goodall) তার এক বক্তৃতায় সহানুভূতি ও দয়া কীভাবে একটি বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়তে পারে তা গুরুত্ব দিয়ে এমনটা বলেছিলেন, ‘শুধুমাত্র যদি আমরা বুঝতে পারি, তখনই আমরা যত্নবান হবো। শুধুমাত্র যদি আমরা যত্নবান হই, তখনই আমরা সাহায্য করব। শুধুমাত্র যদি আমরা সাহায্য করি, তখনই সবাই রক্ষা পাবে’।

আশীষ দত্ত : সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top