ভবনের উচ্চতা বাড়ছে, নিরাপত্তা কি বাড়ছে?
প্রকাশিত:
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:০৪
আপডেট:
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:৩৩

এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব বিন্যাস, নগরজীবন রেখা, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার মানদণ্ড প্রণয়ন, ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়—সবমিলিয়ে ঢাকা মহানগরীকে পরিকল্পিত শহর গড়বার লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ২০২২ সালের ২৪ আগস্ট।
ড্যাপ অনুমোদনের আগেও ছিল দীর্ঘ অপেক্ষা, বারবার সেখানে পরিবর্তন আনা হয়। প্রতি পাঁচ বছরে ড্যাপ আপডেট করার ব্যবস্থা থাকলেও সেটা অনুসরণ না করে ব্যবসায়ী ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের চাপে বারংবার ড্যাপ সংশোধন করার উদ্যোগ শহরের জন্য আত্মঘাতী এবং নগর পরিকল্পনার কার্যকর অনুশীলন এর অন্তরায়।
আবার গুলশান-বানানী ও ধানমণ্ডির মতো অভিজাত এলাকার ফার মান [ফার মান বলতে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (FAR) বোঝায়, যা একটি নির্দিষ্ট প্লটে (জমিতে) নির্মাণযোগ্য ভবনের মোট ফ্লোর এরিয়ার (মেঝে তলার ক্ষেত্রফল) অনুপাতকে বোঝায়।] কমানোর জন্য পরিকল্পনাবিদদের দাবিকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে অভিজাত এলাকার সাথে ফার মানের বিদ্যমান বৈষম্য জিইয়ে রাখা হয়েছে।
অতিরিক্ত ফার মান প্লট মালিকদের অতিরিক্ত অনার্জিত আয়ের সুযোগ করে দেবে। সংশোধনী প্রস্তাবনায় কৃষিজমি, জলাভূমি ও বন্যা প্রবাহ এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বন্ধের সুপারিশ দেওয়া হয়েছে, যা প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি), বেলা, বাপা'সহ অনেক পরিবেশবাদী সংগঠন এই দাবি করে এসেছে দীর্ঘদিন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ড্যাপ-এর প্রস্তাবিত সংশোধন অনুমোদন পেলে ঢাকার আবাসিক এলাকার ফার মান বেড়ে যাওয়ার ফলে আমাদের আবাসিক এলাকা, আবাসস্থল ও বসতবাড়ি কি আরও বাসযোগ্য হবে? আমাদের জীবনের নিরাপত্তা কি আরও বাড়বে?
বাস্তবতা হলো, কোন এলাকার ফার মান দ্বিগুণ হয়ে গেলে আগে যেখানে ৬ তলা ভবন করা যেত, সেখানে এখন ১১-১২ তলা ভবন করা যাবে। ভবনের উচ্চতা ও আকার-আয়তন বেড়ে যাওয়ার ফলে ভবনের ভেতরে আলো বাতাসের পরিমাণ কমে যাবে বহুলাংশে।
বহুতল ভবনে অগ্নি ঝুঁকি কমাতে অগ্নি নিরাপত্তামূলক পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিতে হয়। ভবনে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশের জন্য সুপ্রশস্ত রাস্তা থাকতে হয়। ঢাকা শহরের অধিকাংশ সড়কের প্রশস্ততা ২০ ফুটের নিচে। ৬ ফুট থেকে ১২ ফুটের প্রচুর সড়ক রয়েছে এই শহরে।
এই সব সড়কের পাশে ইমারত বিধিমালা ২০০৮ এর সুযোগ নিয়ে অনেকেই ১০-১২ তলা বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। অথচ আগুন লাগলে এখানে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করবার উপায় নেই। অনেক এলাকাতেই পানির উৎস হিসেবে পুকুর বা জলাশয় ও নেই। নগরায়ণের নামে জলাশয়-জলাধার ভরাট করে ফেলেছি আমরা। ফলে এসব এলাকায় কার্যকরভাবে আগুন নেভানোর কাজ করতে পারবে না ফায়ার সার্ভিস।
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী আমাদের ঢাকা। এই শহরের অনেক এলাকায় প্রতি বর্গকিমি-এ প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করে। অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে অনেক এলাকায় অবকাঠামো ও জনসেবার ওপর চাপ বেড়েছে
এই বাস্তবতা থাকার পরেও সরু রাস্তায় এফএআর (FAR) মান আরও বাড়ানোর জন্য দাবি জানিয়ে আসছে আবাসন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফা বাড়ানো। এর বিপরীতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে জনগণের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ফলে অগ্নিনিরাপত্তা ও জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে সরু রাস্তার পাশে প্লটের ফার মান বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ নগরী আমাদের ঢাকা। এই শহরের অনেক এলাকায় প্রতি বর্গকিমি-এ প্রায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষ বসবাস করে। অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন নির্মাণের কারণে অনেক এলাকায় অবকাঠামো ও জনসেবার ওপর চাপ বেড়েছে।
ফলে জনঘনত্ব ও এফএআর বৃদ্ধির মাধ্যমে জনঘনত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে রাস্তা, পানি, বিদ্যুৎ, ড্রেনেজ, খোলা জায়গা ও স্কুল-হাসপাতালের ওপর অতিরিক্ত চাপ। বাড়বে যানজট, জলজট, তাপমাত্রা ও সার্বিক পরিবেশ দূষণ। ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগে ঝুঁকি বেড়ে যাবে মারাত্মকভাবে।
ঢাকা মহানগরীর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার যেকোনো সংশোধন নাগরিক, পেশাজীবী, কমিউনিটি ও সামাজিক সংগঠনসমূহকে যথাযথ সম্পৃক্ত করবার মাধ্যমে এবং তাদের মতামতের সাপেক্ষে সার্বিক জনকল্যাণ ও শহরের বাসযোগ্যতাকে মাথায় রেখে করতে হবে।
মহাপরিকল্পনাসহ বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়নে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের অবৈধ প্রভাব বন্ধ করা প্রয়োজন। মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে ও পুনর্মূল্যায়নে শহরের বাসযোগ্যতা, ধারণক্ষমতা, নাগরিক সুবিধাদির সুষম বণ্টন, এলাকাভিত্তিক সাম্য, পরিবেশ-প্রতিবেশ, জলাশয়-জলাধার, কৃষিভূমি-জলাধার রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
ড. আদিল মুহাম্মদ খান : অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: