মঙ্গলবার, ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১লা আশ্বিন ১৪৩২


পরাজয়ের অন্তর্নিহিত বাস্তবতা

ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ


প্রকাশিত:
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:৪৪

আপডেট:
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৩:১১

ছবি : সংগৃহীত

এক অদৃশ্য বাস্তবতা সামনে এসেছে—ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী আদর্শ ক্রমাগত পরাজিত হচ্ছে। কেন এ পরাজয়? কেবল কি ছাত্রদের আগ্রহ বা ভোটের অভ্যাস পরিবর্তিত হয়েছে, নাকি এর পেছনে আরও গভীর কাঠামোগত ও নৈতিক সংকট রয়েছে?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের অতীতে ফিরে তাকাতে হয়, বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজ, সুবিধাবাদী নেতৃত্ব, জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের শৈথিল্য বিশ্লেষণ করতে হয়।

১. শিক্ষক সমাজ ও সাদা রঙের সংস্কৃতির অন্তর্লীন জটিলতা

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ছাত্র রাজনীতির ভিত্তি অনেকাংশেই শিক্ষকদের দিকনির্দেশনা ও অভিভাবকসুলভ ভূমিকার ওপর নির্ভরশীল। তবে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের মধ্যে একটি বিশেষ প্রথা গড়ে উঠেছে, যাকে প্রচলিতভাবে বলা হয় “সাদা রঙের সংস্কৃতি”। বাইরে থেকে এটি কেবল শিক্ষকদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার একটি অংশ বলেই মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এর আড়ালে লুকিয়ে আছে বড় ধরনের রাজনৈতিক ও আদর্শিক সমীকরণ।

জাতীয়তাবাদী আদর্শের অনেক শিক্ষক সাদা ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে অন্যরা ভিন্ন আদর্শের প্রতি আনুগত্য পোষণ করেন। প্রকৃত পরিচয় গোপন রেখে তারা এমন এক পরিবেশ তৈরি করেন, যেখানে নতুন প্রজন্মের শিক্ষক ও ছাত্ররা আর প্রকৃত জাতীয়তাবাদী ধারার সঙ্গে পরিচিত হতে পারেনি। বরং এই গোপন আনুগত্য লালনকারীরাই শিক্ষার্থীদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, তাদের ক্যারিয়ার গঠনে প্রভাব ফেলেছেন এবং শেষ পর্যন্ত ছাত্রসমাজে নিজেদের বিকল্প আদর্শ বিস্তার ঘটিয়েছেন।

এখানেই প্রথম বড় বিপর্যয় ঘটে। কারণ ছাত্রসমাজ যাদের অনুসরণ করবে, সেই শিক্ষকরা যদি ভেতরে ভেতরে ভিন্ন আদর্শ লালন করেন, তবে শিক্ষার্থীরাও স্বাভাবিকভাবেই বিভ্রান্ত হবে। অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদী আদর্শ সব সময়ই প্রকাশ্য রাজনীতির চর্চা করেছে। কিন্তু এই প্রকাশ্য অবস্থানের কারণে বিগত ফ্যাসিবাদী শাসনামলে তারা কোনো ক্যাম্পাসে নিরাপদভাবে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে ছাত্রদের সঙ্গে তাদের স্থায়ী ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এই দূরত্বই ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ধারাকে দুর্বল করে দিয়েছে।

২. সুবিধাবাদী ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্বের অন্ধকার

দ্বিতীয় বড় কারণ হলো নেতৃত্বের মান। ইতিহাস সাক্ষী, যেকোনো রাজনৈতিক আদর্শকে সফল করতে হলে প্রয়োজন ত্যাগী, সৎ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের। কিন্তু বাস্তবতা হলো—বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বে ঢুকে পড়েছে কিছু সুবিধাবাদী ও দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ।

এরা বাহ্যিকভাবে দলের পতাকা বহন করে, স্লোগান দেয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একমাত্র লক্ষ্য রাখে নিজের স্বার্থসিদ্ধির দিকে। তারা পদ পাওয়া, সুযোগ গ্রহণ করা বা আর্থিক সুবিধা ভোগ করাকেই রাজনীতি মনে করে। আদর্শ তাদের কাছে কেবল মুখের বুলি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজেও এর প্রভাব পড়েছে। কিছু প্রভাবশালী শিক্ষক জাতীয়তাবাদী পরিচয় বহন করলেও, মূলত তারা নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য কাজ করে গেছেন। এদের কারণে ছাত্ররা সৎ ও আদর্শবান রাজনীতির স্বাদ পায়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা দূরে সরে যাচ্ছে জাতীয়তাবাদী আদর্শ থেকে।

এটা এক ধরনের নৈতিক সংকট। কারণ ছাত্ররা খুব দ্রুত বুঝতে পারে কে সত্যিকারের নেতা আর কে কেবল মুখোশ পরা সুযোগসন্ধানী। আর সেই উপলব্ধি জাতীয়তাবাদী ছাত্র সংগঠনের ভোট ব্যাংকও ক্ষয় করেছে।

৩. জুলাই আন্দোলনের পরবর্তী শূন্যতা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জুলাই আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনের সময় সাধারণ মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, গণতন্ত্র ও অধিকার আদায়ের জন্য একত্রিত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদী আদর্শের নেতৃবৃন্দ দীর্ঘ ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসন উৎখাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করলেও, আন্দোলন শেষ হওয়ার পরপর তারা প্রয়োজনীয় সক্রিয় ভূমিকা রাখেননি।

এই শূন্যতাকে কাজে লাগিয়েছে অন্য আদর্শের মানুষরা। তারা মাঠে-ময়দানে, প্রশাসনে ও প্রতিষ্ঠানগুলোয় সক্রিয় হয়ে নিজেদের লোকজনদের প্রভাবশালী পদে বসিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে প্রশাসনিক নানা পদে, বিভিন্ন একাডেমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আসনে তাদের আধিপত্য তৈরি হয়েছে।

আজ সেই আসনগুলো থেকেই তারা এমন সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, যা জাতীয়তাবাদী অবস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং তারা নিজেদের আদর্শ বাস্তবায়নে তৎপর। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব যখন সিদ্ধান্তহীনতা আর নিষ্ক্রিয়তায় ভুগছিল, তখন অন্যরা দ্রুতই শিকড় গেড়ে বসে গেছে।

জাতীয়তাবাদী নেতাদের এ ভুল বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ময়দানে এর সরাসরি প্রতিফলন পড়েছে—শিক্ষার্থীরা আর জাতীয়তাবাদী সংগঠনকে শক্তিশালী হিসেবে দেখতে পাচ্ছে না।

৪. বিএনপির রাজনৈতিক সংকট ও শুদ্ধি অভিযানের প্রয়োজন

জাতীয়তাবাদী আদর্শের ছাত্র রাজনীতি মূলত বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে জড়িত। ফলে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে এ ধারার পরাজয় আসলে বিএনপির জন্যও এক ধরনের সতর্ক সংকেত।

প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি এই সংকেত উপলব্ধি করছে? রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি যদি সুযোগসন্ধানী নেতৃত্ব, আন্দোলন-পরবর্তী প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণে ব্যর্থতা এবং সংগঠনের ভেতরের দুর্বলতাগুলো সঠিকভাবে বিশ্লেষণ না করে, তবে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

জাতীয় নির্বাচন একটি আলাদা মাত্রার ব্যাপার বটে। সেখানে জাতীয় ইস্যু, গণআন্দোলন, আন্তর্জাতিক চাপ—সবকিছু কাজ করে। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনেক বেশি স্থানীয় ও আদর্শ নির্ভর। এখানে যদি ছাত্ররা জাতীয়তাবাদী আদর্শে আস্থা হারিয়ে ফেলে, তবে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতেও পড়বে।

তাই এখনই প্রয়োজন একটি শুদ্ধি অভিযান। বিএনপিকে স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে—যারা মুখে জাতীয়তাবাদী, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দুর্নীতি ও সুবিধাবাদের রাজনীতি করে, তাদের বাদ দিতে হবে। শিক্ষকদের মধ্যকার গুপ্ত আদর্শিক প্রভাব চিহ্নিত করতে হবে। ছাত্র সংগঠনকে আবারও ত্যাগী, সৎ ও আদর্শবান নেতৃত্ব দিয়ে গড়ে তুলতে হবে।

৫. ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা ও স্বতন্ত্রপথের প্রয়োজন

ইতিহাস বলছে, যে দল বা আদর্শ সময়মতো ভুল থেকে শিক্ষা নেয় না, তারা টিকে থাকতে পারে না। আজ জাতীয়তাবাদী ছাত্র রাজনীতির সংকটও একই শিক্ষা দিচ্ছে।

জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে বুঝতে হবে—শিক্ষার্থীরা এখন আগের মতো অন্ধ অনুসারী নয়। তারা বাস্তবতা বোঝে, নেতৃত্বকে খুঁটিয়ে দেখে। তাই কেবল বড় বড় বক্তৃতা বা স্লোগান দিয়ে তাদের মন জয় করা যাবে না। দরকার সৎ, ত্যাগী নেতৃত্ব, যাদের কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রাণিত হবে।

একইসঙ্গে দরকার স্পষ্ট স্বতন্ত্রবোধ। জাতীয়তাবাদী আদর্শকে যদি অন্য কোনো আদর্শের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হয়, তবে তার স্বকীয়তা হারিয়ে যাবে। আর সেই অস্পষ্টতা শিক্ষার্থীদের দূরে ঠেলে দেবে।

মোটকথা, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী আদর্শের ধারাবাহিক পরাজয়ের মূল কারণ শুধু নির্বাচনী কৌশলের দুর্বলতা নয়; এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংকট। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজের ভেতরে জাতীয়তাবাদী ধারার পাশাপাশি ভিন্ন আদর্শের গোপন প্রভাব, নেতৃত্বে সুযোগসন্ধানী ও দুর্নীতিগ্রস্তদের প্রবেশ, আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের নিষ্ক্রিয়তা, এবং কেন্দ্রীয় দলের অমনোযোগ—সব মিলিয়ে এক জটিল ও গভীর সংকট সৃষ্টি করেছে।

এখনো সময় আছে। বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব যদি বাস্তবতা উপলব্ধি করে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে, তবে ছাত্র রাজনীতিতে আবারও প্রাণ ফিরতে পারে। অন্যথায় ইতিহাস বলবে—তারা সতর্কবার্তা পেয়েও সঠিক পথে হাঁটতে পারেনি।

ড. খালিদুর রহমান : অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top