বুধবার, ১৭ই সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২রা আশ্বিন ১৪৩২


কর্মসংস্থান বাড়াচ্ছে, যাত্রীদের নিরাপত্তা কি নিশ্চিত হচ্ছে?


প্রকাশিত:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১০:৩২

আপডেট:
১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৩:২৮

ছবি : সংগৃহীত

‘রিকশার শহর’ ঢাকা এখন এক নতুন সমস্যার মুখোমুখি, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ব্যাপক বিস্তার। শ্রমিকের কষ্ট লাঘব করছে অটোরিকশা, দ্রুত ও কম খরচে যাত্রী পরিবহন করছে, হাজারও মানুষের আয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে। কিন্তু একই সঙ্গে এর অযাচিত বিস্তার, দুর্বল নকশা, অনভিজ্ঞ চালক ও আইন প্রয়োগের ঘাটতি ঢাকার রাস্তাকে করে তুলছে আরও বিপজ্জনক।

বাংলাদেশে ২০০৮–০৯ সালের দিকে সীমিত আকারে ই-রিকশা চালু হলেও বিগত দশকেই এর বিস্তার দ্রুত বেড়ে যায়। আজ শুধু ঢাকায় নয়, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামীণ সড়কেও লাখ লাখ ইজিবাইক বা অটোরিকশা চলাচল করছে।

বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমানে রাজধানী ও আশেপাশে আনুমানিক ১২–১৪ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে। যাত্রীরা এগুলো বেছে নিচ্ছেন কারণ ভাড়া তুলনামূলক কম (প্রতি কিলোমিটার গড়ে ১০–১৫ টাকা এবং চালকরা সহজেই একাধিক যাত্রী একসাথে বহন করতে পারেন। পাশাপাশি অল্প সময়ে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া যায়।

অটোরিকশা হাজারও নিম্নআয়ের মানুষকে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। যারা শারীরিকভাবে দুর্বল, তারা অটোরিকশা চালিয়ে কম কষ্টে বেশি আয় করছেন। অনেকে প্রতিদিন ৮০০–১২০০ টাকা পর্যন্ত রোজগার করেন, যা প্যাডেল রিকশার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়া ব্যাটারি চার্জিং স্টেশন, ছোটখাটো গ্যারেজ, ব্যাটারি ব্যবসা ও খুচরা যন্ত্রাংশ বিক্রির সঙ্গে আরও অনেক কর্মসংস্থান যুক্ত হয়েছে।

তবে এই ইতিবাচক দিকের আড়ালে রয়েছে বিপুল ঝুঁকি। অধিকাংশ অটোরিকশা স্থানীয় গ্যারেজে প্যাডেল রিকশাকে পরিবর্তিত করে বানানো হয়ে থাকে। এগুলোর স্থিতিশীলতা, সেন্টার-অব-গ্রাভিটি, ব্রেকিং সিস্টেম একেবারেই দুর্বল।

পাশাপাশি ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই অনেকেই হঠাৎ করে চালক হয়ে যাচ্ছেন। ফলে ট্রাফিক আইন অমান্য করার কারণে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রতি মাসেই রাজধানীসহ একাধিক জেলা সড়কে অসংখ্য অটোরিকশা সংক্রান্ত দুর্ঘটনা রিপোর্টে এসেছে এবং এই সংখ্যা দিন দিন আরও বেড়ে চলেছে।

অটোরিকশা চালকরা অনেক সময় সিগন্যাল না দিয়ে লেন বদল করে, উল্টো লেনে চলাচল ও ব্রেক সঠিকভাবে কাজ না করায় সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়াও মোটরসাইকেল-প্রাইভেট গাড়ি মালিকদের কাছ থেকেও নিয়মিত অভিযোগ আসছে যে, অটোরিকশা তাদের গাড়িকে স্ক্র্যাচ বা ক্ষতি করেছে বা ঘষা দিয়ে চলে যাচ্ছে। ঢাকার ব্যস্ত প্রধান সড়কে দ্রুতগতির বাস ও গাড়ির সঙ্গে অটোরিকশা চলাচল মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে।

এছাড়া অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত চার্জিং স্টেশন নেই। চালকরা বাসাবাড়ির বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ব্যাটারি চার্জ দেয় কিংবা অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে থাকে যা লোডশেডিংয়ের সমস্যাও বৃদ্ধি করে। পুরোনো ব্যাটারিগুলো পুনর্ব্যবহার না করে ফেলে দেওয়ায় পরিবেশ দূষণের ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে একেবারে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়, আবার পুরোপুরি অবাধ চলাচলের সুযোগও দেওয়া যাবে না। যদি আমরা অন্যান্য দেশগুলোর দিকে তাকাই, যেমন ভারতের কলকাতায় ‘টোটো’ নামে পরিচিত এসব গাড়ি কয়েক বছর ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছড়িয়ে পড়েছিল।

পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার টোটোর জন্য নির্ধারিত গতিসীমা, নির্দিষ্ট সড়ক ব্যবহারের নিয়ম চালু করেছে। এর ফলে দুর্ঘটনা কমেছে এবং চালকরাও ধীরে ধীরে ভালোমানের গাড়িতে অভ্যস্ত হয়েছে।

চীনে ছোট শহরগুলোয় ই-রিকশার জন্য আলাদা লেন নির্ধারণ করা হয়েছে। নেপাল ও ভুটানেও সীমিত অনুমতিতে ই-রিকশা ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব উদাহরণ দেখায়, কঠোর নিয়মকানুন ও সঠিক অবকাঠামো ছাড়া এগুলোর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

সুতরাং সরকারকে প্রথমে এসব যানবাহনের নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। পাশাপাশি চালকদের প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করতে হবে। শহরে নির্দিষ্ট লেন বা রুট তৈরি করে সেগুলো চালানো হলে জ্যাম ও দুর্ঘটনা কমবে।

BUET-এর গবেষক দল (যান্ত্রিক ও ইলেকট্রিক বিভাগ) BEPRC-এর অর্থায়নে একটি মানসম্মত ‘ইজি বাইক’ মডেল তৈরি করেছে। এই নতুন ডিজাইনে নিরাপদ ব্রেকিং সিস্টেম, অটোমেটিক লক, সিগন্যাল লাইট, রিয়ারভিউ মিরর, সর্বোচ্চ গতি ৩০ কিমি/ঘণ্টা সীমা এবং আবহাওয়া সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে একটি প্রোটোটাইপও তৈরি হয়েছে এবং রাস্তায় টেস্ট রানেও নামানো হয়েছে।

সবশেষে বলা বাহুল্য, মানসম্মত, সার্টিফাইড ‘ইজিবাইক’ মডেল দ্রুতই অনুমোদন ও ম্যানুফ্যাকচারিং স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করতে হবে। স্থানীয় গ্যারেজে অনাবশ্যিক কাস্টমাইজেশন বন্ধ করতে হবে। চালক প্রশিক্ষণ ও লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করতে হবে।

প্রধান রাস্তায় প্রবেশ সীমিত রেখে কেবল স্থানীয় রাস্তা বা নির্ধারিত লেনেই চলাচল নিশ্চিত করতে হবে এবং নিরাপদ চার্জিং অবকাঠামো তৈরি করতে হবে।

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা সুবিধা ও কর্মসংস্থান নিয়ে এসেছে, তবে নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া শহরের সড়ক, পরিবেশ ও মানুষের জীবন ঝুঁকিতে ফেলছে, ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে।

সঠিক নীতিমালা, মান নিশ্চিতকরণ ও বাস্তবসম্মত বাস্তবায়ন ছাড়া এই ‘সুবিধা’ শিগগিরই ভয়াবহ সমস্যায় পরিণত হতে পারে— তাই দ্রুত কিন্তু ন্যায়সংগতভাবে পদক্ষেপ নেওয়াই সমাধান।

সুদীপ্ত সাহা : প্রভাষক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top