মঙ্গলবার, ১৪ই অক্টোবর ২০২৫, ২৮শে আশ্বিন ১৪৩২


চায়না দুয়ারী জালের দৌরাত্ম্যে বিপন্ন জলজ প্রাণ ও মানুষের জীবন জীবিকা


প্রকাশিত:
১২ অক্টোবর ২০২৫ ১০:০৫

আপডেট:
১৪ অক্টোবর ২০২৫ ০৪:৫৯

ছবি : সংগৃহীত

নদী মাতৃক বাংলাদেশে জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী। সংখ্যার দিক দিয়েও নেহাত কম নয়। এ বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও নদী রক্ষা কমিশনের খসড়া তালিকায় স্থান পেয়েছে ১ হাজার ২৯৪টি নদ-নদী।

এছাড়া রয়েছে অগণিত ছোট বড় খাল, বিল আর জলাধার। পৃথিবীর অনেক দেশের মতো এদেশেও নদীকেন্দ্রিক বিস্তার লাভ করেছে জনপদ, শহর, নগর বা বন্দরের। এজন্যই বলা হয়ে থাকে ‘নদীর সাথে আমাদের গভীর মিতালী’।

পৃথিবীর সব সমৃদ্ধ শহরের অবস্থানের সাথে নদীর গতিপথের একটা সম্পর্ক রয়েছে। নদী এবং এর বাস্তুতন্ত্র মিলে আবর্তিত হয় মানুষের জীবন-জীবিকার এক অসাধারণ মেলবন্ধন। যদিও সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণে নদীর গতিপথের পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তন হয়েছে জলাভূমির।

ভরাট হয়েছে নদী, দখল দূষণে জর্জরিত হয়েছে জলাভূমি ও তার আশপাশ। ফলস্বরুপ আমাদের আশেপাশের বেশিরভাগ খাল-বিলের পানি হয়েছে ব্যবহারের অনুপযুক্ত। অথচ একসময় কৃষিকাজের পাশাপাশি গৃহস্থালির নিত্যকাজ বা খাওয়ার জন্যও ব্যবহার হতো নদী খালের পানি! নদী দূষণ এখন বৈশ্বিক সমস্যা।

বাংলাদেশের নদ-নদীতে পাওয়া যায় ২৬০ প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ। এর পাশাপাশি জলজ বাস্তুতন্ত্রের উপাদান হিসেবে রয়েছে হরেক প্রজাতির জলজ উদ্ভিদকুল এবং অমেরুদণ্ডী প্রাণীকুল। বন বিভাগ ও আইইউসিএনের ২০১৫ সালের সর্বশেষ লাল তালিকা অনুযায়ী এদেশের ৬৪ প্রজাতির মাছ নানান রকমের বিলুপ্তির হুমকিতে হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা কারণ হিসেবে শনাক্ত করেছেন দূষণ, অবকাঠামো নির্মাণ, নির্বিচারে বাঁধ নির্মাণ, অবৈধ ও বিষাক্ত উপায়ে মাছ শিকার, নদী ও চর দখল এবং সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এদেশের প্রায় সব নদ, নদী, খাল, বিল এমনকি ডোবা, নালা পর্যন্ত নীরবে এবং ভয়াবহভাবে দখলে যাচ্ছে মহা আগ্রাসী কচুরিপানা দিয়ে।

হাওর কিংবা বাঁওড়, মিঠা কি লোনা পানি, কাপ্তাই লেক থেকে সুন্দরবন সব জায়গায় কচুরিপানার উপস্থিতি! আর সাথে যুক্ত হয়েছে চায়না দুয়ারী বা ম্যাজিক জাল নামক সকল জলজ প্রাণের মৃত্যু ফাঁদ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও উপকূলীয় জলাশয়ে নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী জালের অবাধ ব্যবহার মৎস্যসম্পদ ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুরুর দিকে পদ্মা নদী ও এর আশেপাশের শাখা নদীতে এর ব্যবহার দেখা গেলেও এখন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে সবখানে।

দেশের সর্বত্র ভাইরাসের মতো ছড়িয়ে পড়েছে এই জাল। ছোট ফাঁসযুক্ত এই জালে মাছের পোনা থেকে শুরু করে সব ধরনের জলজ প্রাণী ধরা পড়ছে নির্বিচারে। মাগুরার শালিখা উপজেলায় প্রবাহিত ফটকি নদী থেকে সৃষ্ট এক বিলে আমাদের এক গবেষণায় দেখেছি ৩০-৪০ ফিট দৈর্ঘ্যের একটি চায়না দুয়ারী জালে প্রতিদিন প্রায় ১০-১২ কেজি কাঁকড়া এবং শামুক ধরা পড়ে।

এর সাথে পাওয়া যায় আরও অনেক প্রজাতির জলজ প্রাণী, সাপ, ব্যাঙ বা কচ্ছপ। মাছ বাদে বাকি সব কিছুই (bycatch) সাধারণত ফেলে দেওয়া হয় রাস্তা বা জলাশয়ের পাশে। অথচ এক সময় কম গভীরতার জলাশয়, বর্ষাকালে খালে বিলে বা ধান ক্ষেতে নতুন পানি আসলে বাঁশের তৈরি ঘুনি (মাছ ধরার ফাঁদ) ও চাঁই ব্যবহার করা হতো ছোট দেশীয় মাছ ধরার জন্য।

এই ফাঁদে খুব ছোট পোনা মাছ বা জলজ পোকামাকড় সাধারণত ধরা পড়তো না, ফলে ভারসাম্য বজায় থাকতো জলজ বাস্তুতন্ত্রে। সহজলভ্য চায়না জালের অবাধ বিস্তারে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে দেশীয় উদ্ভাবনের টেকসই এই ফাঁদ। কম পরিশ্রমে অধিক লাভের আশায় তুমুল জনপ্রিয় এখন চায়না জাল।

গবেষণা কাজে অনেক স্থানীয় জেলেদের সাথে কথা বলেছি, তাদের বক্তব্য সস্তা ও সহজলভ্য হওয়ায় অনেকেই এখনো এই জাল ব্যবহার করছেন। ফলে নদীতে প্রজনন মৌসুমে অসংখ্য মাছের ডিম ও পোনা নষ্ট হচ্ছে। এতে কমে যাচ্ছে মাছের স্বাভাবিক সংখ্যা এবং ধ্বংসের মুখে পড়ছে জলজ খাদ্যশৃঙ্খল।

মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চায়না দুয়ারী জাল পুরো প্রজনন চক্র ভেঙে দিচ্ছে। এর কারণে কেবল নদীর মাছ নয়, চিংড়ি, কাঁকড়া, এমনকি অন্যান্য জলজ প্রাণীও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে।

সরকারিভাবে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা আর জনমত তৈরি করা প্রয়োজন। যদিও স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিত অভিযানও চালাচ্ছে। তবে স্থানীয়ভাবে জনসচেতনতা ও বিকল্প জীবিকা নিশ্চিত না হওয়ায় এর ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, টেকসই মৎস্য আহরণ নিশ্চিত করতে হলে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, জেলেদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি ও বিকল্প আয়মুখী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। না হয় চায়না দুয়ারী জালের কারণে নদীভিত্তিক মাছ ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে সরকার তথা দেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারে মিল পাওয়া যায় বিজ্ঞানী গ্যারেট হার্ডিনের ধারণার সাথে। বিজ্ঞানী হার্ডিন ১৯৬৮ সালে একটি জগৎ বিখ্যাত প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করেন কীভাবে সীমিত সাধারণ সম্পদ মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থে অতিরিক্ত ব্যবহৃত হয় এবং এর ফলে সম্পদটি কত দ্রুত শেষ হয়ে যায়।

এই ধারণা ‘The Tragedy of the Commons’ নামে পরিচিত। তিনি ব্যাখ্যা করেন কীভাবে চারণভূমির মতো সাধারণ সম্পদ অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে নষ্ট হয়ে যায়। এই তত্ত্বটি বোঝায় যে, যখন একটি সম্পদ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখন প্রত্যেকে নিজেদের ব্যক্তিগত লাভের জন্য অতিরিক্ত ব্যবহার করতে চায়, যা সামগ্রিকভাবে সবার ক্ষতি করে। চায়না দুয়ারী জালের অতিরিক্ত ব্যবহার এক্ষেত্রে চমৎকার উদাহরণ হতে পারে।

চায়না দুয়ারী জাল মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০ এর আওতায় বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। যদিও আইনে সরাসরি চায়না দুয়ারী জালের নাম উল্লেখ নেই, কিন্তু মৎস্য আইনে সাড়ে চার সেন্টিমিটার বা তার থেকে কম ফাঁসবিশিষ্ট জালের ব্যবহার নিষিদ্ধ।

চায়না দুয়ারী জাল একটি ছোট ফাঁসের জাল হওয়ায় এটি এই আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ। মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এই জাল মজুদ, আমদানি, বাজারজাতকরণ, পরিবহন, নিজের অধিকারে রাখা, প্রদর্শন করা অথবা ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

আমাদের প্রচলিত অনেক আইনের মতো এই আইন সম্পর্কে জনসাধারণের ধারণা নেই এবং অনেক ক্ষেত্রে আইন না মেনে চলাটাই সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার।

আশীষ দত্ত : সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top