আ.লীগ আমলের বৈদেশিক ঋণ নিয়ে বিপাকে অন্তর্বর্তী সরকার
প্রকাশিত:
৭ আগস্ট ২০২৫ ১১:০৫
আপডেট:
৭ আগস্ট ২০২৫ ১৩:২৩

পতিত আওয়ামী লীগ সরকার কোনোরকম যাচাই-বাছাই না করেই ৩ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং ফরাসি উন্নয়ন সংস্থার (এএফডি) কাছ থেকে এ ঋণ নেওয়া হয়। এখন সেই ঋণ গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকাররের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকারের লোকদেখানো উন্নয়ন প্রকল্প হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে বিআরটি। এটি একটি দানবীয় ও অপরিকল্পিত প্রকল্প। আওয়ামী সরকারের এই বৈদেশিক ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কাজ এমন জায়গায় এসে ঠেকেছে যে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি বন্ধও করা যাচ্ছে না, আবার সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে গেলেও অনেক টাকার প্রয়োজন। এমন অবস্থায় চতুর্থ সংশোধনী প্রস্তাবও অনুমোদন করতে পারেনি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিাটি (একনেক)। কেন-কীভাবে প্রকল্পটির উদ্যোগ নেওয়া হলো, কারা সম্ভাব্যতা যাচাই করল, ঋণের চুক্তি কী ছিল-এসবের বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে জানান পরিকল্পনা উপদেষ্টা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে, যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে, সেটি থেকে যেন আউটকাম আসে। ঋণ নেওয়ার উদ্দেশ্য সফল হয়। এ প্রকল্পটি ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৪ বছরে বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু পরে ৫ দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এতেও শেষ হয়নি বাস্তবায়ন কাজ। এবার ২০২৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ ৫ বছর বাড়িয়ে প্রকল্প সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয় পরিকল্পনা কমিশনে। ফলে এটি বাস্তবায়নের মেয়াদ দাঁড়াচ্ছে ১৭ বছর।
এ অবস্থায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কতটা সুফল মিলবে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। প্রকল্পের আওতায় গাজীপুর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্দিষ্ট লেনে বাসভিত্তিক দ্রুত গণপরিবহণব্যবস্থা গড়ে তোলা লক্ষ্য। এর আওতায় ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার বাস র্যাপিড ট্রানজিট স্থাপন ও পরিচালনার মাধ্যমে গাজীপুর-ঢাকার মধ্যে দ্রুত, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব পরিবহণব্যবস্থা প্রবর্তন করার কথা।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বিআরটি প্রকল্প নিয়ে ‘আমরা এখন কী করিব’ অবস্থায় আছি। কেননা এটি নিয়ে কীভাবে এগোনো যায়, সেটি এখনো নিশ্চিত নই। প্রকল্পটিতে ইতোমধ্যে অনেক অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে। অবকাঠামো কাজ অনেক দূর বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু পরিবহণ বাসগুলো এখনো আনার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। প্রকল্পটির কারণে মানুষ ফুটপাতও ব্যবহার করতে পারবে না। হেঁটে রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশে যেতে পারবে না। গাড়ি বা অন্যান্য পরিবহণও প্রয়োজনে পাশ পরিবর্তন করতে পারবে না। প্রশ্ন হলো-এসব অসংগতি শুরুতেই কেন চিন্তা করা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পটি যদ্দূর বাস্তবায়ন হয়েছে, এরপর বাকি কাজ শেষ করতে হলে আরও প্রায় চার হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। এটি একটি দানবীয় এবং অপরিকল্পিত প্রকল্প। কারা প্রকল্পটির উদ্যোগ নিল, কারা সম্ভাব্যতা যাচাই করল এবং ঋণের চুক্তি কী ছিল-এসবের বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরামর্শক নিয়োগের সময় নিচে ছোট করে লেখা থাকে প্রকল্পের সাফল্য-ব্যর্থতায় তাদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। এটা কেউ খেয়ালও করে না। তবে এদেশে যারা তাদের নিয়োগ দিয়েছে, তাদের দায়দায়িত্ব আছে। তবে বৈদেশিক ঋণ থাকায় প্রকল্পটি দ্রুত শেষ করার তাগিদ রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সরকারের চারটি সংস্থা। এগুলো হলো-সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, সেতু কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট পিএলসি। এটি বাস্তবায়নে মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৩৮৯ কোটি ১৫ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণ ১ হাজার ৬৫০ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। পরে তিনবার প্রকল্পটি সংশোধনীর পর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১ হাজার ২৪৫ কোটি ৮৮ লাখ এবং বৈদেশিক ঋণের ৩ হাজার ২২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। প্রস্তাবিত চতুর্থ সংশোধনী প্রস্তাবে নতুন করে ২ হাজার ৩২৯ কোটি ৩৩ লাখ ব্যয় বাড়িয়ে মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৬ হাজার ৫৯৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ২ হাজার ৯০০ কোটি এবং ৩ হাজার ৬৯৭ কোটি ৩৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।
ইআরডির সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটি সময়মতো বাস্তবায়ন হলে ভালো হতো। এখন এই ঋণ থাকায় একদিকে ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্যবাধকতা আছে আবার সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রকল্প থেকেও সুফল মিলছে না। ফলে এই ঋণ এখন গলার কাঁটাই বলা যায়। যে উদ্দেশ্যে ঋণ নেওয়া হয়, সেটিই যদি প্রশ্নবিদ্ধ থাকে, তাহলে তো অনেক বড় সমস্যা। তবে উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করতে হবে। এমন প্রকল্প হাতে নেওয়ার জন্য যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা যায়, ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর এডিবির সঙ্গে ইআরডির ১৬ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি সই হয়। এছাড়া ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি সাড়ে ৪ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি করা হয়। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর এডিবির সঙ্গে অতিরিক্ত ১০ কোটি ডলার ঋণ এবং ২০২৩ সালের ২২ জুন এএফডির সঙ্গে একটি ফ্রেমওয়ার্ক স্বাক্ষর করা হয়। এর আওতায় ১০ কোটি ইউরো ঋণ পাওয়া যায়। এডিবির ঋণের সুদ ২ শতাংশ, ম্যাচুরিটি প্রিমিয়াম শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ এবং অব্যয়িত অর্থের ওপর শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ হারে কমিটমেন্ট চার্জ দেওয়ার শর্ত রয়েছে। এএফডির ঋণেও প্রায় একই শর্ত। এছাড়াও পাঁচ বছরের রেয়াতকালসহ ২৫ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করার কথা। ইতোমধ্যে রেয়াতকালও শেষ হয়ে গেছে।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, গত মে পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ২ হাজার ৮১০ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আর আর্থিক অগ্রগতি ৬৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৭৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। প্রকল্পটির চতুর্থ সংশোধনী প্রস্তাব সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উপস্থাপন করা হলে তা অনুমোদন দেওয়া হয়নি। আরও ভালোভাবে খতিয়ে দেখতে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগকে (আইএমইডি) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: