১০ মাসে ১৯৮ হত্যাকাণ্ড : ‘অবাধ অপরাধের শহর’ হয়ে যাচ্ছে ঢাকা?
প্রকাশিত:
১ ডিসেম্বর ২০২৫ ২২:১৬
আপডেট:
১ ডিসেম্বর ২০২৫ ২৩:২৮
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকায় একের পর এক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটছে। সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে দোকানপাট থেকে শুরু করে অফিস-আদালতে প্রবেশ করছে এবং সবার সামনে ‘টার্গেট কিলিং’ বাস্তবায়ন করছে। এতে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের সংখ্যার দিক থেকে অন্যান্য বছরকে ইতোমধ্যে পেছনে ফেলে দিয়েছে চলতি বছর। রাজধানীর মতো জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন ভয়াবহ অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, গত ১০ মাসে (জানুয়ারি থেকে অক্টোবর) রাজধানীতে ১৯৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নভেম্বরেও আরও কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকা এবং পল্লবীর দুটি ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে মাসে গড়ে প্রায় ১৯ থেকে ২০টি হত্যাকাণ্ড ঘটছে।
সর্বশেষ, গত ১০ নভেম্বর পুরান ঢাকার জনাকীর্ণ এলাকায় প্রকাশ্যে গুলি করে নৃশংসভাবে খুন করা হয় তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। ওই ঘটনার মাত্র এক সপ্তাহের মাথায় গত ১৭ নভেম্বর রাতে পল্লবীতে প্রায় একই কায়দায় গুলি করে হত্যা করা হয় যুবদল নেতা গোলাম কিবরিয়াকে। এভাবে প্রতিনিয়ত নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছে।
সূত্র বলছে, ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের হিসাবে ১০ মাসেই অন্যান্য বছরকে পেছনে ফেলে দিয়েছে চলতি বছর। আগের বছরগুলোতে ১২ মাসে যত হত্যার ঘটনা ঘটেছে এবার ১০ মাসেই তার চেয়ে ৩০-৩৫টি বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে। ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, গণঅভ্যুত্থানের আগের বছরগুলোর মধ্যে ২০২৩ সালে ঢাকায় মোট খুনের ঘটনা ছিল ১৬৫টি, ২০২২ সালে ১৭২টি, ২০২১ সালে ছিল ১৬৬টি। আর এ বছর মাত্র ১০ মাসেই প্রায় ২শ খুনের ঘটনা ঘটে গেছে।
মাদক, আধিপত্য ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ‘টার্গেট কিলিং’
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীতে টার্গেট কিলিং বেড়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি।
এছাড়া, সামনের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং প্রতিযোগিতার কারণেও ঢাকায় হত্যাকাণ্ড ঘটছে বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বও এসব হত্যাকাণ্ডের আরেকটি কারণ।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ধীরে ধীরে তাদের কার্যক্রম নির্বাচনকেন্দ্রিক করছে। এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশকিছু অভিযানের পরও এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটছে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, নির্বাচনি দায়িত্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যত বেশি নিয়োজিত হবেন, তত এ ধরনের অপরাধ বা খুনের ঘটনা বেড়ে যেতে পারে।
রাজনৈতিক আশ্রয়ে সংগঠিত হয়ে নতুন অপরাধ জগৎ সৃষ্টি
ঢাকার বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, গত ৫ আগস্টের পর কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া শীর্ষ সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে নানা ধরনের অপরাধীদের জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তারা এখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয় (শেল্টার) নিয়ে নিজেদের সুসংগঠিত করে পুরোনো নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে ঢাকায় আবার নতুন ‘অপরাধ জগৎ’ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়েছে।
বিশ্লেষকরা অভিযোগ করছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দক্ষতার সঙ্গে এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। বিশেষ করে পুলিশের মনোবল এখনো পূর্ণ রূপে ফিরে আসেনি। তাই সবমিলিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে।
নিরাপত্তা ও অপরাধ বিশ্লেষক এবং মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থার এই অবস্থাটা শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে দেখা যাচ্ছে। শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কিন্তু ঢাকা শহরেই থাকে। ৫ আগস্টের পর তাদের ঢালাওভাবে জামিন দেওয়া হয়েছে। এখন তারা জেল থেকে বের হয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে গিয়ে অপরাধ জগতের কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেছে।
তিনি বলেন, দেশে এখন সামাজিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে। আর রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে দেশে ভালো কিছু হয় না। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এ ধরনের সমস্যাগুলো সংগঠিত রূপে হাজির হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সরকার যেভাবে পরিচালিত হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে পরিচালিত হচ্ছে না— এটাও একটা সমস্যা।
অধ্যাপক ফারুক বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দুর্বলতার জায়গা থেকে বের হয়ে আসাটা অনেক কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। আত্মবিশ্বাস না থাকার কারণে তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন ব্যাহত হচ্ছে। ফলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বেড়ে গেছে। সরকারকে দক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এছাড়া, সব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে এবং এর সঙ্গে বৈধ যে অস্ত্রগুলো আছে, সেগুলো জমা নিয়ে নিতে হবে। কারণ বৈধ অস্ত্র ব্যবহার করেও অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।
কিলিং মিশনে সন্ত্রাসীরা
পুরান ঢাকার আদালত পাড়ার কাছে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ফটকে ১০ নভেম্বর বেলা ১১টার দিকে গুলি করে হত্যা করা হয় মামুনকে। মামুনের স্ত্রী বিলকিস আক্তার পরে ঢাকার সূত্রাপুর থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ১০-১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার বিবরণে বলা হয়, ‘কতিপয় দুষ্কৃতিকারী’ দিনে দুপুরে জনসমক্ষে মামুনকে গুলি করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের পর রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। আদালত চত্বরের মতো নিরাপদ জায়গায় এত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে সেই প্রশ্ন ওঠে।
এই হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতে আরও একটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড ঘটে রাজধানীর পল্লবীতে। গত ১৭ নভেম্বর সেখানে কয়েকজন অস্ত্রধারীর এলোপাতাড়ি গুলিতে গোলাম কিবরিয়া নামে এক যুবদল নেতা নিহত হন। এ ঘটনায় পাঁচজন এজাহারনামীয় এবং ৭ থেকে ৮ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে নিহতের স্ত্রী পল্লবী থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন।
ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, দোকানে মাস্ক ও হেলমেট পরা তিন ব্যক্তি ঢুকে খুব কাছ থেকে কিবরিয়াকে গুলি করে চলে যায়। এ সময় তিনি দোকানে থাকা চেয়ার ধরে লুকানোর চেষ্টা করেন। পাশে অন্যরা থাকলেও অস্ত্রধারীদের কেউ কিছুই করতে পারেননি। মাত্র ১০ সেকেন্ডের মধ্যে কিলিং মিশন শেষ করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়া হত্যার মিশনে ছয়জন অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে তিনজন সরাসরি শুটার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাকি তিনজন ছিলেন ‘ইনফর্মার’ (সোর্স বা তথ্যদাতা)। তারা হত্যাকাণ্ডের মিশনে তিনটি মোটরসাইকেল ব্যবহার করেছেন। খুনের ঘটনার পরপরই জনতার হাতে জনি নামে একজন আটক হন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জনির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এসব তথ্য জানায় পুলিশ।
এছাড়া, গত ১২ নভেম্বর ভোরে মধ্য বাড্ডার কমিশনার গলির একটি মেস থেকে মামুন শিকদার (৩৯) নামে এক যুবকের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত মামুন পেশায় গাড়িচালক ছিলেন। লাশ উদ্ধারের সময় ঘটনাস্থলে ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া যায়। মাদকসংক্রান্ত কারণে তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে পুলিশের ধারণা।
এর আগে বাড্ডা এলাকাতেই প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপি নেতা কামরুল হাসান সাধনকে। তারও আগে গত ২১ মার্চ গুলশানে পুলিশ প্লাজার সামনের সড়কে সুমন মিয়া ওরফে টেলি সুমন (৩৩) নামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানকারী ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
ঢাকায় ঘটে যাওয়া এসব টার্গেট কিলিং নিয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, অপরাধ কখনো কমে না, বাড়েও না। সেদিক দিয়ে ঢাকায় বড় রকমের কোনো পরিবর্তন দেখি না। তবে সামনে যেহেতু নির্বাচন আছে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন একটা ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইলেকশন সম্পর্কিত অনেক আইন আছে, সেগুলো এখন কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে হবে। আইনের কঠিন প্রয়োগ হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। এরকম অবস্থা এর আগেও অনেকবার হয়েছে। এখনকার হত্যাকাণ্ড অধিকাংশ রাজনৈতিক এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক।
হত্যাকাণ্ড নিয়ে ডিএমপির তথ্য ভয়াবহ
রাজধানী ঢাকায় হত্যাকাণ্ড নিয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দেওয়া তথ্য বেশ ভয়াবহ। তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসে এই শহরে ১৯৮টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। গড়ে প্রতি মাসে ঘটেছে ১৯ থেকে ২০টি হত্যাকাণ্ড।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, গত ১০ মাসে রাজধানীতে ১৯৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এগুলো মূলত— পারিবারিক কলহ, পূর্ব শত্রুতার জের ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হচ্ছে। ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ঘটনার সংখ্যা সহনীয় পর্যায়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত বেশিরভাগ খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটনসহ জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আমীর খসরু সম্প্রতি ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে যে কিলিংগুলো হয়েছে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সফলভাবে প্রত্যেকটা ঘটনা উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে। অস্ত্র উদ্ধার করেছে। সর্বশেষ পুরান ঢাকায় যে মার্ডারটা হয়েছে, সেখানেও গোয়েন্দা পুলিশ অস্ত্র উদ্ধার করেছে এবং আসামিদের গ্রেপ্তার করেছে। এর আগে ২৬ টুকরো লাশ উদ্ধারের ঘটনাও উদঘাটন করা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে কোনো ঘটনা ঘটলে তার নেপথ্যের কারণ উদঘাটন করে আনা এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার বিষয়ে।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: