শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


নিষেধাজ্ঞা কী, কেন দেওয়া হয়, কোন দেশের ওপর কত নিষেধাজ্ঞা


প্রকাশিত:
২২ মে ২০২৩ ২১:৫৭

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১২:৪৯

 ফাইল ছবি

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র কোনও দেশ বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে সেটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর প্রায়ই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন। কোনও দেশ নিষেধাজ্ঞা দিলে তার মিত্র অন্যান্য দেশ ও সমর্থনকারী প্রতিষ্ঠানও তা মেনে চলে। বিপরীতে কোনও দেশ চাইলে পাল্টা নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারে।

তবে সেসব নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকরী তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অবশ্য বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কোনও দেশ বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে সেটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি বা প্রভাব সৃষ্টি করে।

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাব ও এর কয়েকজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে সেই ঘটনার দেড় বছর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবারও নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে বেশ জোরেশোরে আলোচনায় উঠে এসেছে।

তবে এই নিষেধাজ্ঞা আসলে কী, কেন দেওয়া হয়? আর বিশ্বের কোন দেশের ওপর ঠিক কত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা আছে?

নিষেধাজ্ঞা কী?

সাধারণ ভাষায় কোনও দেশ আরেকটি দেশকে বা নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে। এমন দেশ থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় যেসব দেশে ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের যাতায়াত, বিনিয়োগ বা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে।

আবার নিষেধাজ্ঞা অনেক সময় এক দেশ আরেক দেশের ওপর প্রতিশোধ হিসেবেও আরোপ করে থাকে। যেমন, রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রতিশোধে পাল্টা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সহজ কথায় বলতে গেলে এক দেশ অপর দেশের ওপর শাস্তি হিসেবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়।

গত শনিবার এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলেছে, নিষেধাজ্ঞা হলো একটি দেশ কর্তৃক অন্য দেশের ওপর আরোপিত শাস্তি। মূলত অভিযুক্ত দেশের আক্রমণাত্মক আচরণ বা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করা বন্ধের জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কোনও দেশ চাইলে খুব অল্প সময়ের নোটিশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।

কেন দেশগুলো একে অপরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়?

২০১৮ সালের আগস্টে সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইউনিভার্সিটি অব স্যালফোর্ডের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মরটিজ পিয়েপার বলেন, ‘আপনি একটি দেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারেন। কারণ আপনি ওই দেশটির আচরণে পরিবর্তন দেখতে চান।’

বিষয়টা হলো- ‘ওই দেশের নাগরিক তার নিজ দেশের সরকারের ওপর রাগান্বিত হবে। এবং দাবি জানাবে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ভিত্তিতে সরকার যেন তার ভুল শোধরায়।’

কী কী ধরনের নিষেধাজ্ঞা আছে?

২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি শিল্পের কিছু কোম্পানির মালামাল রাশিয়ায় রপ্তানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এসব পণ্যের মধ্যে মেশিনারি ও ইলেকট্রিক্যাল পার্টসও ছিল। এই বাণিজ্য ছিল মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের।

অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র সেসময় যেসব নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল সেগুলো অর্থনৈতিক। তারা কোম্পানিগুলোকে নিষেধ করেছে যাতে তারা রাশিয়ায় পণ্য বিক্রি না করে।

২০১৮ সালে বিবিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, আবার দেশগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাও আনতে পারে। তবে নিষেধাজ্ঞা কিছু কিছু সময় কঠিন হতে পারে এবং এর একটা সামগ্রিক ফলাফল থাকে।

তবে ‘স্মার্ট নিষেধাজ্ঞা’ নামে একটা ধারণা আছে। মূলত যখন পুরো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি না করে ছোট কোনও গ্রুপের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তখন তাকে ‘স্মার্ট নিষেধাজ্ঞা’ বলা হয়।

কোন দেশের ওপর কত নিষেধাজ্ঞা আছে?

বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় নিষেধাজ্ঞাকে সাধারণত এক ধরনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১৯৯০ এর দশকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় নানা ঘটনাপ্রবাহে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশ হচ্ছে রাশিয়া।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে রাশিয়ার ওপর দফায় দফায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ। এতে পিছিয়ে নেই অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো প্রশান্ত মহাসাগরীয় বা দূরপ্রাচ্যের দেশও।

নিষেধাজ্ঞা আরোপে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন করছে ইউরোপের বহু দেশ। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর পশ্চিমা দেশগুলো সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিয়ে, বরং এর বিপরীতে তারা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়াকে দুর্বল করার পথ বেছে নেয়।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে জার্মানভিত্তিক গবেষণা সংস্থা এবং মার্কেট ও কনজিউমার ডেটা প্ল্যাটফর্ম স্ট্যাটিস্টার এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, ইউক্রেনে আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশ হয়ে উঠেছে রাশিয়া।

স্ট্যাটিস্টার সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রুশ নাগরিক ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর ১৪ হাজার ৮১টি নিষেধাজ্ঞা ছিল। এটি পূর্ব ইউক্রেনের লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার আগের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে নিষেধাজ্ঞা আরোপের শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ১ হাজার ৯৪৮টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অন্যদিকে, নিষেধাজ্ঞা আরোপের তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা সুইজারল্যান্ড এবং কানাডা যথাক্রমে ১ হাজার ৭৮২টি ও ১ হাজার ৫৯০টি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

মস্কোর ইউক্রেন আক্রমণের আগে ইরান ছিল বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত রাষ্ট্র। পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত এবং ইসরায়েলের মতো দেশগুলোর আরোপিত ৩ হাজার ৬১৬টি সক্রিয় নিষেধাজ্ঞা ছিল।

তবে পারমাণবিক কর্মসূচিকে ঘিরে বিরোধ ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বৈরী অবস্থানের কারণে ইরানের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে এবং ফেব্রুয়ারির সেই পরিসংখ্যানে ইরানের বিরুদ্ধে বর্তমানে সবমিলিয়ে ৪ হাজার ১৯১টি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বৈশ্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকি ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট কাস্টেলাম-ডট-এআইয়ের তালিকা অনুযায়ী, নিজেদের ওই তালিকা প্রস্তুত করে স্ট্যাটিস্টা। কাস্টেলাম-ডট-এআইয়ের তালিকায় নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটির বিরুদ্ধে মোট নিষেধাজ্ঞা ছিল ২ হাজার ৬৪৩টি।

অন্যদিকে, তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে থাকা উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে রয়েছে ২ হাজার ১৩৩টি নিষেধাজ্ঞা। এছাড়া তালিকায় পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে বেলারুশ, মিয়ানমার ও ভেনেজুয়েলা। এই তিন দেশের মধ্যে নিষেধাজ্ঞার মোট পরিমাণ যথাক্রমে ১ হাজার ১৫৫টি, ৮০৬টি এবং ৬৫১টি।

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে সবাই বাধ্য?

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের সকল নাগরিক বা দেশটিতে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি রয়েছে, এমন ব্যক্তি যেখানেই থাকুন না কেন তারা অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল (ওএফএসি) নির্দেশনা মেনে চলতে বাধ্য।

অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যখন কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সেইসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা দেশের সঙ্গে মার্কিন কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোনও রকম লেনদেন বা সম্পর্ক রক্ষা করতে পারে না। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে, এমন কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানও সেটি করতে পারে না। যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে, তারা যুক্তরাষ্ট্রেও প্রবেশ করতে পারবেন না।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা বন্ধু দেশগুলো মানতে বাধ্য নয়। কিন্তু কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি বা অস্ট্রেলিয়ার মতো যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তারাও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অনুসরণ করে থাকে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top