এফ-৭: চীনা প্রযুক্তির পুরোনো বিমান, আধুনিক যুদ্ধের অনুপযোগী?
প্রকাশিত:
২২ জুলাই ২০২৫ ১৭:২০
আপডেট:
২২ জুলাই ২০২৫ ১৭:৫৫

সোভিয়েত আমলের মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের আদলে তৈরি চীনা কোম্পানি চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশনের (সিএসি) এফ-৭ যুদ্ধবিমান নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। ২০১৩ সালের পর থেকে চীন আর এই বিমানের উৎপাদন করে না। বিশ্বের কোনও দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ না করলেও পুরোনো প্রযুক্তি ও বারবার দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় বিশ্বজুড়ে বিমানটির ব্যবহার কমে গেছে। বর্তমানে চতুর্থ ও পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না চীনা এই বিমান। সামরিক নিরাপত্তা বিশ্লেকরা বলছেন, আধুনিক যুদ্ধের জন্যও উপযুক্ত নয় এফ-৭। পাশাপাশি এই বিমানের নিরাপত্তা রেকর্ড নিয়ে বিশ্বজুড়ে গুরুতর উদ্বেগ রয়েছে।
সোমবার রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে থাকা চীনা এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তে অন্তত ৩১ জন নিহত ও দেড় শতাধিক আহত হয়েছেন। সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে বিমানটি উড্ডয়নের কয়েক মিনিট পর বিধ্বস্ত হয় বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে।
• কোন কোন দেশ ব্যবহার করে?
যুদ্ধবিমান ও বিমানের যন্ত্রাংশের নকশা প্রণয়ন এবং উৎপাদানকারী চীনা কোম্পানি চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশনের (সিএসি) তৈরি এফ-৭ বিজিআই মূলত বহুমুখী অভিযান ও উন্নত প্রশিক্ষণে সক্ষম একটি হালকা যুদ্ধবিমান। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী বিশেষভাবে এই বিমান তৈরি করে চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন।
চীনের চেংদু জে-৭ যুদ্ধবিমানের সিরিজের উন্নত রপ্তানি সংস্করণ এফ-৭। ১৯৬৫ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই বিমান তৈরি করেছিল সিএসি। ২০১৩ সালে চীন ১৬টি এফ-৭ বিমান বাংলাদেশে রপ্তানি করে। সেটিই ছিল এই বিমানের শেষ চালান। এরপর থেকে চীন এফ-৭ বিমানের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।
বর্তমানে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরান, মিয়ানমার, নামিবিয়া, নাইজেরিয়া, উত্তর কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, সুদান, তানজানিয়া এবং জিম্বাবুয়ের মতো কিছু দেশ এই বিমান ব্যবহার করছে। আধুনিক যুদ্ধবিমানের তুলনায় কম খরচ আর রক্ষণাবেক্ষণ সহজ হওয়ায় তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল বিভিন্ন দেশে এফ-৭ সিরিজের বিমান রয়েছে।
• নিষিদ্ধ নয়, তবে অপ্রচলিত
সামরিক বিমানের ক্ষেত্রে ‘নিষিদ্ধ’ বলতে সাধারণত আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বা গুরুতর নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে সম্পূর্ণ ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া বোঝায়। চীনা এফ-৭ যুদ্ধবিমানের ব্যবহার কোনও দেশই সরাসরি নিষিদ্ধ করেনি। তবে বিশ্বের কিছু দেশ তাদের সামরিক বাহিনীর বহর থেকে এফ-৭ যুদ্ধবিমান সরিয়ে নিচ্ছে কিংবা নতুন বিমান দিয়ে প্রতিস্থাপন করছে।
চীনা এই বিমানের নকশা অনেক পুরোনো। আধুনিক যুদ্ধবিমানের মতো এই যুদ্ধবিমানে উন্নত রাডার, ডেটা লিঙ্ক, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম কিংবা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের সক্ষমতা নেই। এফ-৭ যুদ্ধবিমান মূলত ‘পয়েন্ট ইন্টারসেপ্টর’ হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ শত্রুপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধের সময় আকাশ প্রতিরক্ষা ও দ্রুত পাল্টা প্রতিক্রিয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় এই বিমান।
• পশ্চিমে কী এই বিমান আছে?
বিশ্বের বর্তমান বাস্তবতায় পশ্চিমা বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে চীনের তৈরি সামরিক সরঞ্জামের ব্যবহারে বিধি-নিষেধ রয়েছে। বিশেষ করে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য ও তাদের মিত্র দেশগুলোতে চীনের সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
চীনের চিরবৈরী প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো সাধারণত চীনা প্রযুক্তির ওপর আস্থা রাখে না। সাইবার নিরাপত্তা ও ইন্টেলিজেন্স ঝুঁকির কারণে তারা চীনা প্রযুক্তিকে এড়িয়ে চলে।
পশ্চিমের পাশাপাশি চীনের প্রতিবেশী ভারত, ভিয়েতনাম কিংবা তাইওয়ানও কৌশলগত নীতির কারণে চীনা সামরিক সরঞ্জামের ব্যবহার করে না। যে কারণে এসব দেশে এফ-৭ যুদ্ধবিমান নিষিদ্ধ না হলেও বাস্তবে এর ব্যবহার নেই।
পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, চীনা সামরিক যন্ত্রে সম্ভাব্য নজরদারি ও তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি রয়েছে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এসব বিমান ব্যবহার থেকে বিরত থাকে।
• বাংলাদেশে এফ-৭ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনার যত রেকর্ড
১৯৯২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর (বিএএফ) ২৭টি বিমান দুর্ঘটনার রেকর্ড রয়েছে। এর মধ্যে কেবল গত দুই দশকে হওয়া ১১টি দুর্ঘটনার ৭টিই ছিল চীনের তৈরি বিমান।
সোমবার ঢাকার উত্তরায় একটি এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়। এতে পাইলটসহ ৩১ জন নিহত ও ১৬৫ জন আহত হয়েছেন।
বিমান বাহিনীর ওই বিমানে মাঝ-আকাশে প্রযুক্তিগত ত্রুটি দেখা দিয়েছিল বলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পাইলট ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে বিমানটিকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার রেকর্ড এটি।
এছাড়াও বাংলাদেশে এফ-৭ যুদ্ধবিমানের আরও কয়েকটি দুর্ঘটনার রেকর্ড রয়েছে।
• ২৩ নভেম্বর, ২০১৮ : টাঙ্গাইলের মধুপুরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর বহরে থাকা একটি চীনা এফ-৭ বিজি বিধ্বস্ত হয়। সেই সময় বিমানের পাইলট উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ দীপু মারা যান।
• ২৯ জুন, ২০১৫ : চীনা এফ-৭এমবি বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয়। সাগরে পড়ে যাওয়া ওই বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তাহমিদ নিখোঁজ হন।
• ৮ এপ্রিল, ২০০৮ : টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে বিধ্বস্ত হয় একটি চীনা এফ-৭ যুদ্ধবিমান। বিমান থেকে বেরিয়ে আসার পরও স্কোয়াড্রন লিডার মোর্শেদ হাসান মারা যান।
ডিএম /সীমা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: