আরব নিউজের প্রতিবেদন
ভারতে অভিবাসন ক্র্যাকডাউনের মধ্যে আটকের ভয়ে বাঙালি মুসলিমরা
প্রকাশিত:
৮ আগস্ট ২০২৫ ১৯:৪৯
আপডেট:
৮ আগস্ট ২০২৫ ২২:২৫

ভারতে বাংলাভাষী মুসলিমরা বলছেন, তারা আটক এবং নির্বাসনের ভয়ে বাস করছেন। দেশটিতে ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযান বেড়ে চলেছে। এর ফলে শত শত লোককে অবৈধভাবে বাংলাদেশে জোরপূর্বক প্রবেশ করতে বাধ্য করা হয়েছে। যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই ভারতীয় নাগরিক।
বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দেওয়া জুলাই মাসের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ৭ মে থেকে ১৫ জুনের মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি মুসলিমকে যথাযথ প্রক্রিয়া ছাড়াই সীমান্ত দিয়ে ‘বহিষ্কার’ করা হয়েছে, যাদের মধ্যে নারী ও শিশুও রয়েছে।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘অবৈধ অভিবাসীদের’ বিরুদ্ধে ভারতে দমন-পীড়ন নতুন নয়। তবে গত এপ্রিল মাসে জম্মু ও কাশ্মীরে হামলার পর বর্তমান দমন-পীড়নের ধারাটি শুরু হয়েছে।
দিল্লি এই হামলার জন্য ‘পাকিস্তানের সন্ত্রাসীদের’ দায়ী করার পর ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি শাসিত রাজ্যগুলো হাজার হাজার বাঙালি মুসলিমকে আটক করেছে। তাদের সন্দেহভাজন ‘অবৈধ অভিবাসী’ এবং ‘সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকি’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
৫৩ বছর বয়সী ভারতীয় নাগরিক এবং আসাম রাজ্যের প্রাক্তন স্কুলশিক্ষক খাইরুল ইসলাম আরব নিউজকে বলেন, ২৪ মে পুলিশ তাকে তার বাড়ি থেকে আটক করে। তারপর আরও ১৪ জনের সঙ্গে জোর করে বাংলাদেশে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, ‘এটা একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছিল, আমাকে ভারত ও বাংলাদেশের মাঝামাঝি একটা নো-ম্যানস-ল্যান্ডে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। যখন আমি ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করি তখন ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে।’
খাইরুল ইসলামের স্ত্রী এবং আত্মীয়-স্বজনরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে তার নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য নথিপত্র দেখানোর প্রায় এক সপ্তাহ পরে তিনি তার দেশে ফিরতে সক্ষম হন।
তিনি বলেন, ‘আমার দাদা ভারত থেকে এসেছিলেন। আমার কাছে ভারতে তার স্কুলের পড়াশোনার একটি কপি আছে - তার অষ্টম শ্রেণীর সার্টিফিকেট। আমার বাবা ১৯৫২ সালে সরকারের কাছ থেকে বন্দুকের লাইসেন্স পেয়েছিলেন। আমি একজন সরকারি কর্মচারী ছিলাম এবং ১৯৯৭ সালে শিক্ষক হিসেবে চাকরি পেয়েছি।’
‘এটা তো সহজ হয়রানি। আসামে বাঙালি মুসলিম হওয়া অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের জীবন নরকে পরিণত হয়েছে...। তারা আমাকে বিদেশি বলে ডাকে, কারণ আমি একজন মুসলিম এবং একজন বাঙালি। এই জাদুকরী শিকারে অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে... আমি আশা করি আমাদের প্রতি ন্যায়বিচার হবে।’
বাংলা বাংলাদেশের প্রধান ভাষা হলেও ভারতে আনুমানিক ১০ কোটি বাংলাভাষী রয়েছে। তারা মূলত আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্যে বাস করে। তাদের মধ্যে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মুসলমান হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়।
হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতের কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, অনিয়মিত অভিবাসন রোধ করার জন্য এই ‘বহিষ্কার’ করা হয়েছে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে ‘মুসলিম অনুপ্রবেশ’ ভারতের পরিচয়ের জন্য হুমকিস্বরূপ।
তিনি বলেছেন, ‘আমরা নির্ভীকভাবে সীমান্তের ওপার থেকে চলমান, অনিয়ন্ত্রিত মুসলিম অনুপ্রবেশ প্রতিহত করছি, যা ইতোমধ্যেই একটি উদ্বেগজনক জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশ কয়েকটি জেলায়, হিন্দুরা এখন তাদের নিজস্ব ভূমিতে সংখ্যালঘু হওয়ার পথে।’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপ-পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, অবৈধ অভিবাসীদের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি দেশটিকে ‘খারাপ দৃষ্টিতে দেখাচ্ছে’।
তিনি আরব নিউজকে বলেন, যদিও সরকার অনিয়মিত অভিবাসন মোকাবেলা করতে পারে, তবে এটি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করতে হবে। বিজেপি-শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষী মুসলিম কর্মীদের এলোমেলোভাবে আটক করে ধরে নেওয়া এবং তাদের বাংলাদেশি নাগরিক বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।
আসামের মতো রাজ্যগুলোতেও সম্প্রতি হাজার হাজার পরিবারকে উচ্ছেদের ঘটনা বেড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সরকারি জমিতে অবৈধভাবে বসবাসের অভিযোগ এনেছে।
মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘চলমান উচ্ছেদগুলো ধর্মীয় বা জাতিগত ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক আচরণের একটি রাষ্ট্রীয় নীতি বলে মনে হচ্ছে, যা সাংবিধানিক সুরক্ষাকে লঙ্ঘন করে।’
গোলাঘাট জেলায় নিজ বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া আসামের বাসিন্দা শাজি আলীও সরকারি বর্ণনা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখানে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার বাবা ৪০ বছরেরও বেশি সময় আগে নওগাঁ জেলা (বাংলাদেশের) থেকে এখানে এসেছিলেন। পূর্ববর্তী সরকারই আমাদের এখানে বসতি স্থাপন করে দিয়েছিল।’
তিনি আরব নিউজকে বলেন, ‘আমাদের এখানে সকল সরকারি সুযোগ-সুবিধা আছে। আমরা কীভাবে দখলদার হয়ে গেলাম? (বর্তমান) সরকারের জন্য, আমাদের বাঙালি-মুসলিম পরিচয় একটি সমস্যা।’
অল আসাম মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সেক্রেটারি মিন্নাতুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, চলমান কর্মকান্ডের পেছনে রাজনীতি জড়িত।
তিনি আরব নিউজকে বলেন, ‘আজ আসামে এক অমানবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বাংলাভাষী মুসলমানরা চরম আতঙ্কের মধ্যে বাস করছে...। এটি একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ এবং আসাম সরকার ২০২৬ সালের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং উচ্ছেদ নির্বাচনী এজেন্ডার অংশ।’
তিনি আরও বলেন, ‘লক্ষ্য হলো বাংলাভাষী মুসলিমরা। প্রায় ৯০ লাখ বাঙালি মুসলিম থাকবে। এটা স্পষ্ট যে, আসামে কোনো বাংলাদেশি নেই। সরকার যাই করছে... তা উপযোগী নয়, কেবল রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য মুসলিমদের টার্গেট করছে।’
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: