আশা ও বাস্তবতার সন্ধিক্ষণে স্বাস্থ্য বাজেট
প্রকাশিত:
১৬ জুন ২০২৫ ১১:২৭
আপডেট:
১৬ জুন ২০২৫ ১৯:৪৪

স্বাস্থ্যখাত সেই গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত, যেটি নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার কমতি নেই। এবারের বাজেট ঘোষণার প্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য বাজেট কতটা আশান্বিত, কতটা সংস্কারমুখী এবং কতটা বাস্তবায়নযোগ্য—তা এখনই বিশ্লেষণ করা জরুরি।
স্বাস্থ্য বাজেটের পরিসংখ্যান
চলতি অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে ৪১,৯০৮ কোটি টাকা, যা গত বছরের ৪১,৪০৭ কোটি টাকার তুলনায় মাত্র ৫০১ কোটি টাকা বেশি। মোট জাতীয় বাজেটের ৫.৩ শতাংশ এই খাতে বরাদ্দ হয়েছে, যা গত বছরের ৫.২ শতাংশের তুলনায় সামান্য বেশি।
পার্সেন্টেজের হিসেবে এটি কিছুটা স্বস্তির জায়গা তৈরি করলেও, এই সামান্য বৃদ্ধি কি আমাদের স্বাস্থ্য খাতের বিশাল চাহিদা পূরণে যথেষ্ট? বিশেষ করে, যখন আমরা জানি যে স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাস্তবায়নে আমাদের সক্ষমতা বরাবরই প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে স্পষ্ট। ৪১,৪০৭ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে প্রায় ১৪,০০০ কোটি টাকা রিভিশনের সময় কেটে নেওয়া হয়। এরপরও যে অংশ বাকি ছিল, বছর শেষে তারও প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ খরচ করা সম্ভব হবে না। ফলে, বাজেটের প্রায় অর্ধেক অংশ ব্যবহার হবে না। এই প্রেক্ষাপটে, এবারের প্রায় ৪২,০০০ কোটি টাকার বাজেট কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
বরাদ্দের গঠন ও অগ্রাধিকার
বাজেটের বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্নয়ন বাজেটের তুলনায় পরিচালন বাজেটে জোর দেওয়া হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় স্বাস্থ্যখাতের বহু পদ খালি রয়েছে, যা চিকিৎসাসেবা ব্যাহত করছে। বিশেষ বিসিএস ও জরুরি নিয়োগের মাধ্যমে এই শূন্যতা পূরণের ইঙ্গিত বাজেটে থাকলেও তা কতটা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হবে, সেটাই দেখার বিষয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে ক্লাস্টার ভিত্তিক নতুন ডিপিপি প্রণয়ন চলছে। এর মধ্যে মেডিকেল এডুকেশন ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় উন্নয়নের লক্ষ্যে কিছু অব্যাহত প্রকল্প যেমন রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত বরাদ্দ বজায় রাখা হয়েছে। তবে নতুন প্রকল্প গ্রহণে কার্যত স্থবিরতা দেখা গেছে, যা দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যখাতের সম্প্রসারণকে সীমিত করবে।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও বাজেটের প্রতিফলন
জাতীয় স্বাস্থ্য সংস্কার কমিশন মে মাসের ৫ তারিখে তাদের রিপোর্ট পেশ করেছে। এই রিপোর্টে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে সর্বজনীন করার জন্য বড় অঙ্কের বাজেট বরাদ্দের কথাও বলা হয়েছে।
বাজেট তৈরির প্রক্রিয়া মার্চ-এপ্রিল থেকে শুরু হয়, আর সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট এসেছে মে মাসে। ফলে, এই সুপারিশগুলো এবারের বাজেটে পুরোপুরি প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে, কিছু ক্ষেত্রে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আংশিক প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, শূন্য পদে নিয়োগের বিষয়ে কমিশন জোর দিয়েছে এবং এবারের বাজেটে বেশ কিছু নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে, স্পেশাল বিসিএস ও তড়িৎ নিয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের জনবলের ঘাটতি পূরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবুও, এই পদক্ষেপগুলো কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নির্ভর করছে বাস্তবায়নের ওপর।
চ্যালেঞ্জ কোথায়?
স্বাস্থ্য বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর বাস্তবায়ন। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাজেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সক্ষমতার অভাবে ভুগছে। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে—
১. প্রশাসনিক জটিলতা: স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান বাধা হচ্ছে প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনা। ডিজি হেলথ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং ফিল্ড লেভেলের প্রশাসনের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের অভাব প্রকট। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোতে দক্ষতার অভাব রয়েছে। সচিবালয়-ভিত্তিক প্রশাসনের স্বাস্থ্য খাত সম্পর্কে গভীর জ্ঞান নেই, আর ডিজি হেলথ-ভিত্তিক প্রশাসনের প্রশাসনিক দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে, ফাইল চালাচালি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হয়।
২. ক্রয় নীতির অনমনীয়তা: বর্তমান ক্রয় নীতি (প্রকিউরমেন্ট পলিসি) স্বাস্থ্য খাতের জন্য উপযোগী নয়। স্বাস্থ্য খাতে হাজারও ধরনের ওষুধ, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কিনতে হয়, কিন্তু সাধারণ ক্রয় নীতি এই জটিলতা মোকাবিলায় ব্যর্থ। স্বাস্থ্য খাতের জন্য আলাদা ক্রয় নীতি প্রণয়ন জরুরি।
৩. জনবলের ঘাটতি: স্বাস্থ্য খাতে শূন্য পদের সংখ্যা বিপুল। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত—চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থেকে শুরু করে ক্লিনার পর্যন্ত পদ শূন্য রয়েছে। নিচের সারির পদের ঘাটতি পূরণে স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে আউটসোর্সিংয়ের ওপর নির্ভর করা হচ্ছে, যা কার্যকর সমাধান নয়।
৪. অডিট ভীতি: স্বাস্থ্য খাতের ম্যানেজাররা ক্রয়-সংক্রান্ত কাজে জড়াতে ভয় পান, কারণ অডিটে আপত্তি উঠলে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়। এমনকি সঠিক নিয়ম মেনে কেনাকাটা করলেও অডিটের আপত্তি ও দুর্নীতির চাপে অনেকে ‘কিছু না করার’ পথ বেছে নেন। এর ফলে হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
৫. অপর্যাপ্ত সমন্বয়: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ফলে, প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতা দেখা দেয়।
৬. উন্নয়ন বাজেটের অপব্যবহার: উন্নয়ন বাজেটের বড় অংশ ফেরত যায়, কারণ প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিয়োগে সমস্যা, কন্ট্রাক্টর নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বৃদ্ধি পায়। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর পরিচালকরা বেশিরভাগ সময় অভিজ্ঞতাহীন এবং স্বল্প মেয়াদের নিয়োগপ্রাপ্ত।
পাঁচ বছরের প্রকল্পে তিনবার পিডি বদল হয়—ফলে ধারাবাহিকতা থাকে না। উপরন্তু, রাজনৈতিক প্রভাব ও সিন্ডিকেট-নির্ভর কন্ট্রাক্ট বিতরণ প্রকল্প বাস্তবায়নে আরও বিলম্ব ঘটায়। একটি তিন বছরের প্রকল্প আট বছরে শেষ হয়, অথচ মূল্যস্ফীতি ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সেই প্রকল্পের কার্যকারিতা ততদিনে অনেকাংশে কমে যায়।
সমাধানের পথ
স্বাস্থ্য বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে আমাদের কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে—
১. স্বাস্থ্য খাতের জন্য আলাদা সার্ভিস গঠন: সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস নামে একটি স্বতন্ত্র সার্ভিস গঠন করা যেতে পারে। এটি জুডিশিয়াল সার্ভিসের মতো কাজ করবে, যেখানে স্বাস্থ্য পেশাজীবীরা নিজেরাই এই খাতের সিদ্ধান্ত নেবেন। এতে প্রশাসনিক মিসম্যাচ কমবে।
২. ম্যানেজারিয়াল দক্ষতা বৃদ্ধি: স্বাস্থ্য খাতে ম্যানেজারিয়াল দক্ষতা বাড়াতে ম্যানেজমেন্ট স্ট্রিম আলাদা করা যেতে পারে। এই স্ট্রিমের কর্মকর্তারা শুরু থেকেই প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ পাবেন।
৩. ক্রয় নীতি সংস্কার: স্বাস্থ্য খাতের জন্য আলাদা ক্রয় নীতি প্রণয়ন করতে হবে, যা এই খাতের জটিল চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। এছাড়া, অডিট প্রক্রিয়াকে আরও নমনীয় ও স্বচ্ছ করতে হবে।
৪. জনবলের ঘাটতি পূরণ: শূন্য পদে স্থায়ী নিয়োগ দিতে হবে। আউটসোর্সিংয়ের পরিবর্তে নিয়মিত নিয়োগ ও পোস্টিং-ট্রান্সফার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৫. সমন্বয় বৃদ্ধি: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এই কমিটি বাজেট বাস্তবায়নের বাধাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের পথ বাতলে দেবে।
৬. দুর্নীতি প্রতিরোধ: কন্ট্রাক্টর নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব ও সিন্ডিকেটের প্রভাব কমাতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। অডিটে দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ করতে হবে।
৭. পিডি নির্বাচনে দক্ষতা ও ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা: প্রকল্প পরিচালকের বয়স, মেয়াদকাল এবং অভিজ্ঞতা বিবেচনায় এনে দীর্ঘমেয়াদি নিয়োগ দিতে হবে, যাতে প্রকল্পে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে।
৮. সংবেদনশীলতার সঙ্গে অডিট পদ্ধতি সংস্কার: অডিট প্রক্রিয়া যেন দক্ষ ম্যানেজারদের অনাকাঙ্ক্ষিত হয়রানির কারণ না হয়, সে লক্ষ্যে স্বাস্থ্যখাত-উপযোগী অডিট গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে।
প্রত্যাশা
স্বাস্থ্য একটি মৌলিক অধিকার। সংস্কার কমিশন প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে আইনগত অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে। এবারের বাজেট যদি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। তবে, আগামী বছরগুলোয় আমাদের আরও উচ্চাভিলাষী হতে হবে। মোট বাজেটের ১৫ শতাংশ বরাদ্দের দিকে এগোতে হবে।
এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা বেশি। এই সরকার যদি স্বাস্থ্য বাজেটের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় বাজেট দাবি করার যৌক্তিক ভিত্তি তৈরি হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে।
শেষ পর্যন্ত, স্বাস্থ্য বাজেটের সাফল্য নির্ভর করছে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর। এই বাজেট যেন কাগজে-কলমে থেকে না যায়, বরং জনগণের সেবায় পৌঁছে যায়—এটিই আমাদের সবার কামনা। সুস্থ জাতি গঠনে এবারের বাজেট একটি মাইলফলক হয়ে উঠুক, এই প্রত্যাশা নিয়ে আমরা এগিয়ে যাই।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ।। অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; আহ্বায়ক, অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশ (এএইচআরবি); আহ্বায়ক, নেটওয়ার্ক ফর হেলথ কেয়ার এক্সেলেন্স (এনএইচই)
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: