নারী শিক্ষায় ইসলামের আলোকিত উত্তরাধিকার
প্রকাশিত:
২৮ জুলাই ২০২৫ ১৮:৩৬
আপডেট:
২৮ জুলাই ২০২৫ ১৯:০৯

যে সভ্যতার সূচনা হয়েছিল একটি শব্দ দিয়ে, সেই শব্দটি ছিল—“পড়ো”। এটি ছিল মানবজাতির প্রতি প্রথম আহ্বান, একটি বিপ্লবী ঘোষণা যে অজ্ঞতার অন্ধকার ভেদ করে জ্ঞানের আলোয় পথচলা ছাড়া মুক্তি নেই। স্রষ্টা ঘোষণা করেছিলেন, “পড়ো, তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (কুরআন, সূরা আল-আলাক: আয়াত ১)
এই নির্দেশ কোনো পুরুষের জন্য এককভাবে ছিল না; বরং মানবতার জন্য ছিল সমানভাবে প্রযোজ্য। ইসলামের প্রথম বার্তাই প্রমাণ করে যে নারী ও পুরুষের মাঝে জ্ঞানার্জনের অধিকার ও দায়িত্বে কোনো বিভাজন নেই।
ইসলামের ইতিহাসে নারী ছিলেন কেবল গৃহকোণে নীরব কোনো চরিত্র নয়; বরং জ্ঞানের মশাল হাতে সভ্যতার আলোকবর্তিকা। রাসুল সা. এর স্ত্রী আয়েশা রা. ছিলেন এমন এক মহীয়সী পণ্ডিত, যার থেকে দুই হাজারের বেশি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
তিনি শুধু নারী শিক্ষার প্রতীক নন, বরং পুরুষ আলেমদের শিক্ষকও ছিলেন। তাফসিরে ইবনে কাসিরের প্রণেতা ইসমাইল ইবনে উমর ইবনে কাসির আদ-দিমাশকি রহ. লিখেছেন, “আয়েশা রা. এর জ্ঞানের পরিধি বহু আলেম পুরুষের জ্ঞানকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।”
তাবেঈ যুগে দামেস্কের মসজিদে বসে উম্মুদ দুরদা আস-সুঘরা রহ. যেভাবে নারী ও পুরুষ উভয়কেই পাঠদান করেছেন, তা প্রমাণ করে ইসলামী জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে নারীর অবস্থান কতটা সম্মানজনক ও কেন্দ্রীয়।
কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেন, “তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাসী এবং জ্ঞানপ্রাপ্ত, আল্লাহ তাদের মর্যাদা উচ্চ করবেন।” (কুরআন, সূরা মুজাদালাহ: আয়াত ১১)
এখানে লিঙ্গের কোনো সীমারেখা টানা হয়নি; বরং আল্লাহর দৃষ্টিতে জ্ঞানই মর্যাদার মূল মাপকাঠি।
এই কারণেই রাসুল সা. বলেছেন, “জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর বাধ্যতামূলক।” (ইবনে মাজাহ, হাদিস ২২৪)
এখানে মুসলিম শব্দটি নারী ও পুরুষ উভয়কেই সমানভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইসলামি আইনবিদ ইমাম নববী রহ. মন্তব্য করেছেন, “যে জ্ঞান দ্বীন ও নৈতিকতার সঠিকতা নিশ্চিত করে, তা নারী ও পুরুষের জন্য সমানভাবে ফরজ।”
শুধু ধর্মীয় জ্ঞানের ক্ষেত্রেই নয়, উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞানেও মুসলিম নারীর অবদান ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। নবম শতকে মরক্কোর ফেজ নগরীতে ফাতিমা আল-ফিহরি রহ. যে আল-কাইরাউইন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটিই আজ বিশ্বের প্রাচীনতম সচল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃত।
এক হাজার বছর আগে একজন নারী যখন জ্ঞানের এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন, তখন তা প্রমাণ করে ইসলামের বুকে নারীশিক্ষা শুধু অনুমোদিত নয়, বরং তা ইসলামী সভ্যতার গর্বের অংশ।
আজকের পৃথিবীতে নারীশিক্ষা কেবল সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্ন নয়; এটি একটি জাতির আত্মার মুক্তির প্রশ্ন। রাসুল সা. বলেছেন, “যে ব্যক্তি জ্ঞান অনুসন্ধানের পথে চলে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৬৯৯)
এই প্রতিশ্রুতি নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। একজন নারী শিক্ষিত হলে কেবল তিনিই নয়, তার হাতে গড়ে ওঠে একটি শিক্ষিত প্রজন্ম। একজন মা যদি অশিক্ষিত হন, তবে সেই ঘরে সভ্যতার আলো ম্লান হয়ে যায়।
ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে যেখানে নারী জ্ঞানের আলোয় দীপ্ত, সেখানেই সভ্যতা সমৃদ্ধ। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাব্দীপ্রাচীন প্রাঙ্গণ থেকে শুরু করে আধুনিক বিজ্ঞান গবেষণাগার পর্যন্ত মুসলিম নারীরা আজও প্রমাণ করে চলেছেন যে ইসলাম নারীকে জ্ঞানচর্চার অধিকার শুধু দেয়নি, বরং সেই পথকে সম্মানের সোপানে উন্নীত করেছে।
আজ যখন কিছু সমাজে নারীর শিক্ষা নিয়ে সংকীর্ণতার দেওয়াল তোলা হয়, তখন ইতিহাসের দর্পণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এটি ইসলামের সত্যিকারের রূপ নয়। ইসলাম কখনো নারীর মস্তিষ্কে তালা দেয়নি; বরং তার হাতে দিয়েছে জ্ঞানের প্রদীপ।
সেই প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়েছে সভ্যতার অগণিত অধ্যায়। আমাদের দায়িত্ব সেই প্রদীপকে আবারও প্রজ্বলিত করা। কারণ একজন শিক্ষিত নারী মানে কেবল একজন আলোকিত মানুষ নয়; বরং একটি প্রজন্ম, একটি জাতি ও একটি সভ্যতার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: