বৃহঃস্পতিবার, ১১ই সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৭শে ভাদ্র ১৪৩২


বিলাল (রা.) যেভাবে প্রিয়নবী (সা.)-এর মুয়াজ্জিন হলেন


প্রকাশিত:
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৭:৩১

আপডেট:
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৯:৫৫

ছবি- সংগৃহীত

মক্কার উমাইয়া ইবনে খালফের ক্রীতদাস ছিলেন হজরত বিলাল ইবনে রাবাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু। দাস হওয়ার কারণে তার ওপর যেকোনো ধরনের জুলুম নির্যাতনের বিপক্ষে আওয়াজ তোলার কেউ ছিল না। তাই তিনি যখন ইসলাম গ্রহণ করলেন, তখন তা শুনে মনিব উমাইয়া গরম তাওয়ায় সেঁকা রুটির মতো তেতে ওঠল। তার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালালো।

বিলাল (রা.)-এর ওপর অবর্ণীয় নির্যাতন দেখে তাকে উমাইয়া ইবনে খালফের কাছ থেকে কিনে মুক্ত করে দিলেন হজরত আবু বকর (রা.)। এরপর থেকে তিনি স্বাধীন, মুক্ত জীবনযাপন করতে শুরু করলেন।

মুশরিকদের নির্যাতনে মৃতপ্রায় হয়েও তাওহিদকে আঁকড়ে ধরেছিলেন হজরত বিলাল। এই ধৈর্য ও অবিচলতার বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা তাকে দান করলেন এক সুমহান মর্যাদা। হজরত আবু বকরের মহানুভবতায় বিলালের কষ্টের জীবন শেষ হলো।

এদিকে মক্কায় তেরো বছরের তাওহিদি মিশনের পর রাসুলের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ এলো, মদিনায় হিজরত করে ইসলামকে একটা সার্বভৌমিক রূপ দিতে। দীনের তাকাজা নিয়ে হজরত বিলাল তখন মদিনায় হিজরত করলেন। সেখানে তিনি হজরত সাদ ইবনে খুসায়মা রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর ঘরে অতিথি হলেন। তিনি, হজরত আবু বকর ও আমর ইবনে ফিহর একঘরে অবস্থান করলেন।

মদিনার অনভ্যস্ত পরিবেশে তারা আক্রান্ত হলেন ঠাণ্ডা জ্বরে। জ্বরের প্রকোপ থেকে সুস্থ হয়ে বিলাল (রা.) কবিতার মাধ্যমে তার মক্কায় ফেলে আসা দিনগুলোর কথা খুব স্মরণ করতেন। রাসুল তাকে হজরত আবু রুওয়াইহা আবদুল্লাহ ইবনে আবদুর রহমান খুসয়ামি রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করে দিলেন। রাসুলের এই বন্ধনকে বিলাল আজীবন রক্ষা করেছিলেন।

দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর শাসনকালে বিলাল সিরিয়া অভিযানে মুজাহিদ বাহিনির সাথে শরিক হয়েছিলেন। হজরত ওমর তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিলাল, তোমার ভাতা কে উঠাবে? বিলাল উত্তর দিয়েছিলেন, আবু রুওয়াইহা। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের মাঝে যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করে গেছেন, তা কখনো বিচ্ছিন্ন হতে পারে না!

মদিনায় এসে হজরত বিলাল হয়ে গেলেন একজন নির্ভার মুক্তপ্রাণ মানুষ। এই সুযোগে তিনি রাসুল ও দীনের খেদমতে নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে দিলেন। মদিনায় এসে রাসুল একটি ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করলেন। মসজিদে নববিকে ঘিরে তৈরি করলেন প্রাশাসনিক অবকাঠামো।

প্রথম হিজরিতে আজানের প্রচলন হলো। সুউচ্চ কণ্ঠে ইসলামের মহিমা প্রচার এবং সকল মুসলমানকে মসজিদে সমবেত করার এই মহান দায়িত্ব লাভ করলেন হজরত বিলাল। সেই থেকে চিরকালের জন্য তিনি বরিত হয়ে গেলেন ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন এবং রাসুলের মুয়াজ্জিন হিসেবে।
মদিনায় অবস্থান এবং মদিনা থেকে সফরে বের হলে বিলাল সবসময় ছিলেন রাসুলের মুয়াজ্জিন। তার সুগভীর সুমধুর সুর সবাইকে বিপুল বিমোহিত করত। আজান শেষ হওয়ামাত্র মদিনার মুসল্লি দিয়ে মসজিদ ভরপুর হয়ে যেত।

বিলাল যখন রাসুলের হুজরার সামনে গিয়ে ডাকতেন, হাইয়্যাআলাস সালাহ! হাইয়্যাআলাল ফালাহ! আসসালাত ইয়া রাসুলাল্লাহ! তার ডাক শুনে রাসুল হুজরা থেকে বের হতেন। রাসুলকে বের হতে দেখে বিলাল নামাজের জন্য ইকামত শুরু করতেন। বিলাল ছাড়াও মসজিদে নববিতে আরও দুজন মুয়াজ্জিন ছিলেন—আবু মাহজুরা এবং আমর ইবনে উম্মে মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহুমা।

রাসুলের মুয়াজ্জিন হিসেবে বিলাল আরেকটা গুরুদায়িত্ব লাভ করলেন। রাসুল তাকে নিয়োগ দিলেন বায়তুল মালের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে। সেখান থেকে বিলাল মদিনার গরিব-দুস্থদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতেন। যুদ্ধের খরচাদি, মুজাহিদদের ভাতা, আসহাবে সুহফার জীবিকানির্বাহ এবং দীনি ও সামাজিক কাজে নানান অনুদান দিতেন; সেইসাথে রাসুলের ঘরের হাঁড়ির খবরও তাকে রাখতে হত।

রাসুল ও উম্মুল মুমিনিনরা যখন উদারহাতে নিজেদের সবকিছু মানুষের মাঝে দান করে দিতেন, তখন হজরত বিলাল পার্থিব প্রয়োজনের সম্বলটুকু রেখে দিতেন নিজের বগলের নিচে। রাসুলের ঘরে অনাহার দেখা দিলে সেটুকু তিনি বের করে দিতেন। আল্লাহ ও রাসুলের ভালোবাসায় সর্বস্ব ত্যাগ দিয়ে এভাবেই বিলাল নিজের অধিষ্ঠান তৈরি করে নিয়েছিলেন।

রাসুলের খাদিম এবং দীনের সেবায়েত হয়ে মসজিদে নববিতে কেটে যেত বিলালের দিনরাত। অভাব, অনাহার সব সয়ে যেতেন অম্লানবদনে। রাসুলকে তিনি ভালোবাসতেন নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি। তার দরিদ্রতা থাকলেও সামর্থ্যানুযায়ী রাসুলকে হাদিয়া দিতেন।

একবার কিছু খেজুর নিয়ে গেলেন রাসুলের দরবারে। রাসুল জিজ্ঞেস করলেন, বিলাল, এগুলো কোথায় পেলে? তিনি জবাব দিলেন, আল্লাহর রাসুল, আমার কাছে দুইসা’ নিম্নমানের খেজুর ছিল। সেগুলো বদল দিয়ে একসা’ ভালো খেজুর নিয়ে এলাম আপনার দরবারে। রাসুল বললেন, এমন করলে কেন? এটা তো সুদ হলো। এমন করতে হলে সেগুলো আগে বিক্রি করে এর মূল্য দিয়ে এগুলো কিনতে! ভালোবেসে বলা রাসুলের এই শিক্ষা বিলাল আজীবনের জন্য গেঁথে নিলেন নিজের সিনায়।

রাসুলও বিলালকে অনেক ভালোবাসার চোখে দেখতেন। দেখতে কুচকুচে কালো হলেও তার ভেতরটা ছিল ঈমানের আলোয় ঝকঝকে উজ্জ্বল। তাই রাসুল থেকে নিয়ে মদিনার দেহাতি লোকেরা পর্যন্ত তাকে ভালোবাসত।
একবার রাসুলের দরবারে হাবশার বাদশাহ নাজাশির পক্ষ থেকে তিনটি বর্শা হাদিয়া এলো। রাসুল সেগুলোর একটি দিলেন হজরত আলীকে, একটি হজরত ওমরকে, আরেকটি নিজের কাছে রেখে দিলেন। এটি তিনি হাদিয়া দিলেন হজরত বিলালকে। রাসুলের এই ভালোবাসার হাদিয়াকে বিলাল বুক দিয়ে আগলে রাখলেন। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি এই বর্শাটি নিয়ে যেতেন। দুই ঈদ এবং ইসতিসকার নামাজে এটি হাতে নিয়ে তিনি রাসুলের আগে আগে চলতেন।

মসজিদ ছাড়া অন্য কোথাও নামাজের জামাত দাঁড়ালে বর্শাটিকে সুতরা বানিয়ে রাসুলের সামনে গেড়ে দিতেন। রাসুলের মুয়াজ্জিন হজরত বিলাল এভাবেই মহিমান্বিত হয়ে উঠছিলেন সকলের চোখে।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top