ঢাকার মাঠে যেভাবে মৃত্যু হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটারের
 প্রকাশিত: 
 ১২ মার্চ ২০২৫ ১২:১২
 আপডেট:
 ৪ নভেম্বর ২০২৫ ১৪:৩৯
                                অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার ফিলিপ হিউজের মৃত্যু নাড়া দিয়েছিল পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে। ক্রিকেট মাঠে চোট পাওয়ার সবচেয়ে মারাত্মক আর বিষাদময় উদাহরণ সম্ভবত এটিই। ২০১৪ সালে শেফিল্ড শিল্ডের এক ম্যাচে শন অ্যাবটের এক বাউন্সার গিয়ে আঘাত হানে ফিল হিউজের মাথায়। সেই যে লুটিয়ে পড়েছিলেন মাঠে, আর ওঠা হয়নি। দুই দিন পর শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সম্ভাবনাময় এ ব্যাটসম্যান।
১৯৯৮ সালে ঢাকার মাঠে এমনই এক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটার রমন লাম্বা। প্রিমিয়ার লিগের দল আবাহনী লিমিটেডের হয়ে খেলতে এসে ফিল্ডিংরত অবস্থায় বলের আঘাত পেয়েছিলেন লাম্বা। তিনদিন পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। খুব সম্ভবত বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিয়োগান্তক ঘটনাও হয়ে আছে রমন লাম্বার মৃত্যু।
দিনটি ছিল ১৯৯৮ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারি। ঢাকার ঘরোয়া টুর্নামেন্টে জাতীয় স্টেডিয়ামে মুখোমুখি দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী এবং মোহামেডান। খেলার শেষদিকে ব্যাটসম্যানের খুব কাছে শর্ট লেগে ফিল্ডিং করতে আসেন আবাহনীর হয়ে খেলা রমন লাম্বা। তার কয়েক মুহূর্ত পরেই মেহেরাব হোসেন অপির এক শর্টে গুরুতর আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়তে হয় ভারতের হয়ে একসময় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা ৩৮ বছর বয়সী ক্রিকেটার রমন লাম্বাকে।
সে সময় রমন লাম্বার কাছাকাছিই দাঁড়িয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল, লাম্বা ঠিক আছে কি না, জিজ্ঞেস করতে যান। রমন বলেন, ‘ম্যায় তো মার গায়া বুলি! (আমি তো মরে গেলাম বুলবুল!)। প্রথমে চোটটা অত গুরুতর না লাগলেও অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে আক্রান্ত হন লাম্বা। লাম্বাকে পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ভর্তি করা হয়। বেশ কয়েকজন ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় দিল্লি থেকে উড়িয়ে আনা হয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। তাতেও কাজ হয়নি, লাম্বা আর ফেরেননি। কোমায় থেকে ৩ দিন পর মৃত্যুবরণ করেন।
দুর্ঘটনাটির প্রত্যক্ষদর্শী আবাহনীর ম্যানেজার শেখ মামুন স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন, শর্ট বলে মেহরাব হোসেন অপি পুল করলে বলটি রমন লাম্বার মাথায় লাগে আর ১০ গজ দূরে পাইলট সেই বলটি ক্যাচ ধরেন। মেহরাব হোসেন অপি আউট, ম্যাচ আমি জিতেছি, কিন্তু রমন লাম্বাকে আর পাইনি। তিনদিন অজ্ঞান থাকার পর সে হাসপাতালে মারা যায়।
তিনি বলছিলেন, খেলার মাত্র কয়েকটি বল বাকি থাকায় বিপদজনক ঐ স্থানে হেলমেট পড়তে চাননি রমন লাম্বা। আমরা তাকে বলেছিলাম হেলমেট নিতে। কিন্তু সে বললো ‘আরে ইয়ার অনলি ওয়ান বল’, কিন্তু সেই একটা বলই লাগলো তার গায়ে। জানা যায়, ব্যাটসম্যানের কাছাকাছি ফিল্ডিং করার সময় হেলমেট না পরার এক বদভ্যাসও ছিল এই তারকার। ভারতের হয়ে খেলার সময়ও একই কাজ করতেন। শোনা যায়, প্রেমিকার জন্যই নাকি এমনটা করতেন।
ঘটনাটি অনেক দিন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে মেহরাব হোসেনকে। একদিনের ক্রিকেটে দেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ান লাম্বার অকাল মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী করেন। মানসিক অবসাদে ভুগেছেন বহুদিন। রাতে ঠিকমতো নাকি ঘুমাতেও পারতেন না।
ঢাকাই ক্রিকেটের বড় তারকা!
১৯৮৬ সালে ভারত জাতীয় দলে অভিষেক হয় দিল্লীর ছেলে রমনের। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি খেলেছেন ৪টি টেস্ট আর ৩২টি ওয়ানডে। ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান সাদা পোশাকের টেস্টে ১০২ রান তোলেন। সর্বোচ্চ ৫৩ রানের স্কোর ছিল তার। ওয়ানডেতে একটি সেঞ্চুরি আর ছয়টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৭৮৩ রান করেছেন। ১৯৮৯ এর পর থেকে জাতীয় দলে আর ফেরা হয়নি তার। কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজের নাম অমর করে গেছেন। আয়ারল্যান্ডে খেলেছেন বড় একটা সময়। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট তো ছিলই, সাথে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নিজেকে বানিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। বলা হয়, ঢাকাই ক্রিকেটে তিনিই প্রথম বিদেশি মহাতারকা। শুরু করেছিলেন ধানমণ্ডি পাড়ার আবাহনী লিমিটেড দিয়ে। এরপর ব্রাদার্স ইউনিয়ন, জিমসিসি ক্লাব ঘুরে আবারও আবাহনীতে থিতু হয়েছিলে। এখানেই অকাল প্রয়াণ।
ঢাকায় রমনের ক্যারিয়ারটা টিকেছে মোটে ৭ বছরের মতো। ১৯৯১-৯২ মৌসুমে শুরু, ১৯৯৮ সালে মাঠ থেকেই শেষ। অভিষেক মৌসুমে আবাহনীর হয়ে ম্যাচ অব দ্য সিরিজের পুরস্কার জিতেছিলেন রমন লাম্বা। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার।
রমন লাম্বাকে মনে রাখেনি বাংলাদেশ
টেস্ট-পূর্বযুগে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তারা হয়ে এসেছিলেন রমন লাম্বা। তার অকাল প্রয়াণের ২৭ বছর পূর্ণ হয়েছে এই গেল ফেব্রুয়ারিতেই। যদিও এক সময় দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের জৌলুস বাড়ানো ভারতীয় এই ক্রিকেটারকে সে অর্থে মনে রাখার কোনো কারণ বাংলাদেশ এখনও খুঁজে পায়নি। যে আবাহনী লিমিটেডের হয়ে খেলতে গিয়ে মাত্র ৩৮ বছরে চলে গিয়েছিলেন দুনিয়ার ওপারে, দেশের শীর্ষস্থানীয় সেই ক্লাবেও নেই রমনের কোনো স্মৃতিচিহ্ন। যদিও খালেদ মাসুদ পাইলট কিংবা যার বলের আঘাতে মৃত্যু সেই অপিদের স্মৃতিতে আছেন লাম্বা।

                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
                                                    
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: