মায়ের কবরে শান্তি ও মর্যাদাবৃদ্ধির সবচেয়ে কার্যকর আমল কী
প্রকাশিত:
৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:০০
আপডেট:
৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ ২১:০৭
মায়ের মতো আপন পৃথিবীতে আর কেউ নেই। সন্তান পৃথিবীতে আসার পর থেকে আমৃত্যু মা যে ত্যাগ, ভালোবাসা ও কষ্ট স্বীকার করেন, তার ঋণ শোধ করা অসম্ভব। মৃত্যুর পর যখন এই প্রিয় মানুষটি অন্ধকার কবরে একা শায়িত হন, তখন তাঁর আমলের খাতা বন্ধ হয়ে যায়। সেই নির্জন সময়ে নেক সন্তানের পাঠানো দোয়া ও আমল হয় মায়ের সম্বল ও শান্তির মাধ্যম।
হাদিস ও শরিয়তের আলোকে মায়ের কবরে শান্তি পৌঁছানো এবং জান্নাতে তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির সবচেয়ে কার্যকর আমলগুলো নিচে আলোচনা করা হলো।
১. নেক সন্তানের দোয়া ও ইস্তেগফার
মায়ের কবরের আজাব মাফ এবং জান্নাতে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ও সরাসরি আমল হলো সন্তানের ‘ইস্তেগফার’ বা ক্ষমা প্রার্থনা। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি আমল জারি থাকে- ১. সাদকায়ে জারিয়া, ২. উপকারী জ্ঞান এবং ৩. নেক সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ (সহিহ মুসলিম: ১৬৩১; আবু দাউদ: ২৮৮০)
সন্তান যখন মায়ের জন্য হাত তোলে, আল্লাহ তাআলা তা ফেরান না। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘মানুষের মৃত্যুর পর (জান্নাতে) তার মর্যাদা হঠাৎ বৃদ্ধি করা হয়। তখন সে অবাক হয়ে বলে, হে প্রভু! আমার এই মর্যাদা কোত্থেকে এল? আল্লাহ বলেন, ‘তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা (ইস্তেগফার) করেছে, তাই এই মর্যাদা দেওয়া হলো।’ (মুসনাদে আহমাদ: ১০৬১০; আল-আদাবুল মুফরাদ: ৩৬)
করণীয়: প্রতি ওয়াক্ত নামাজের সেজদায়, শেষ বৈঠকে এবং বিশেষ মুহূর্তে মায়ের জন্য রাব্বুল আলামিনের শেখানো দোয়াটি বেশি বেশি পড়া- ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।’ অর্থ: ‘হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছেন।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ২৪) ‘আলেমদের বর্ণনায় এসেছে- ‘মৃতের জন্য দোয়া তার কাছে উপহারের মতো পৌঁছে।’
২. দান ও সদকায়ে জারিয়া
মৃত মা বাবার পক্ষ থেকে দান করা অনেক উপকারী আমল। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার মা মৃত্যুবরণ করেছে। যদি আমি তার পক্ষে সদকা (দান) করি তাহলে এতে তার কোনো উপকার হবে? রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, হ্যাঁ। এরপর লোকটি বলল, আপনাকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমি আমার একটি ফসলের ক্ষেত তার পক্ষ থেকে সদকা করে দিলাম। (সুনানে নাসায়ি: ৩৫৯৫)
এছাড়াও মা-বাবার পক্ষ থেকে এমন কোনো জনকল্যাণমূলক কাজ করা উত্তম, যার সওয়াব কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকে।
সদকায়ে জারিয়ার কিছু উদাহরণ: মসজিদ নির্মাণ, মকতব-মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, দ্বীনি পাঠাগার ও কিতাবের ব্যবস্থা করা, ঈদগাহ বানানো, কবরস্থান করা, যেকোনো দ্বীনি কাজে জমি ওয়াকফ করা, এতিম ও অসহায় লোকদের বাসস্থান ও উপার্জনের ব্যবস্থা করা, রাস্তা ও পুল নির্মাণ করা, পানির ব্যবস্থা করা, ফলদার বৃক্ষ রোপণ করা, সরাইখানা তৈরি করা ইত্যাদি।
৩. মায়ের আত্মীয় ও বান্ধবীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা
মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি ভালোবাসা দেখানোর অন্যতম মাধ্যম হলো, তিনি যাদের ভালোবাসতেন তাদের সম্মান করা। এটি কবরে মায়ের রুহের জন্য প্রশান্তির কারণ হয় এবং সন্তানের জন্য বড় নেক আমল হিসেবে গণ্য হয়।
রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় নেক কাজ হলো- কোনো সন্তানের জন্য তার বাবার (বা মায়ের) মৃত্যুর পর তাদের বন্ধু-বান্ধব ও ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।’ (সহিহ মুসলিম: ২৫৫২)
আমল: মায়ের বোন (খালা), বান্ধবী এবং আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া, তাদের বিপদে পাশে দাঁড়ানো এবং হাদিয়া পাঠানো। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) তাঁর পিতার বন্ধুদের দেখলে বিশেষ সম্মান করতেন এবং বলতেন, ‘বাবার ভালোবাসার মানুষদের সম্মান করাই হলো তাঁর প্রতি প্রকৃত সম্মান।
৪. মায়ের অসিয়ত ও ঋণ আদায় করা
মায়ের যদি কোনো ঋণ থাকে বা তিনি কোনো বৈধ অসিয়ত করে যান, তবে তা দ্রুত আদায় করা সন্তানের ওপর আবশ্যক। ঋণ মানুষের জান্নাতে যাওয়ার পথে বড় বাধা।
এছাড়া মায়ের কোনো ইবাদত অপূর্ণ থাকলে তা পূরণ করা সন্তানের দায়িত্ব। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, এক মহিলা নবীজি (স.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার মা হজের মানত করেছিলেন কিন্তু তা পালন না করেই ইন্তেকাল করেছেন। আমি কি তাঁর পক্ষ থেকে হজ করতে পারি?’ নবীজি (স.) বললেন, ‘হ্যাঁ, তাঁর পক্ষ থেকে হজ আদায় করো।’ (সহিহ বুখারি: ১৮৫২)
একইভাবে কাজা রোজা সম্পর্কেও হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি মারা গেল অথচ তার জিম্মায় রোজা বাকি ছিল, তার পক্ষ থেকে তার ওলি (উত্তরাধিকারী সন্তান) যেন রোজা রাখে।’ (সহিহ বুখারি: ১৯৫২)
৫. ভালো কাজের ধারা অব্যাহত রাখা
মা যদি জীবদ্দশায় কোনো ভালো কাজ বা সুন্নত চালু করে থাকেন (যেমন গরিবদের খাওয়ানো, কোরআন শিক্ষা দেওয়া), তবে সন্তানের উচিত তা চালু রাখা। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামে একটি ভালো পথের সূচনা করল, সে যতদিন মানুষ সেই পথে চলবে, ততদিন তার জন্য সমপরিমাণ সওয়াব লেখা হবে।’ (সহিহ মুসলিম)
৬. ফিদিয়া আদায় করা
মৃতব্যক্তির ছুটে যাওয়া নামাজ-রোজার জন্য প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পরিবর্তে এবং প্রতি রোজার পরিবর্তে এক মুদ (বর্তমান হিসাবে পৌনে দুই কেজি) পরিমাণ গম সদকা করা। ইকরিমা (রহ) বলেন, আমার মা প্রচণ্ড তৃষ্ণা-রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং রোজা রাখতে সক্ষম ছিলেন না। তাঁর সম্পর্কে আমি তাউস (রহ)-কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, প্রতিদিনের পরিবর্তে মিসকিনকে এক মুদ (বর্তমান হিসাবে পৌনে দুই কেজি) পরিমাণ গম প্রদান করবে। (মুসান্নাফে আবদুর রাজজাক: ৭৫৮১) ফিদিয়া আদায়ের এই পদ্ধতি হানাফি ফিকহ অনুযায়ী।
৭. কোরআন তেলাওয়াত ও নফল ইবাদত
মায়ের রুহের মাগফেরাতের নিয়তে গরিব-দুঃখীকে খাবার খাওয়ানো এবং কোরআন তেলাওয়াত করে সওয়াব রেসানি করাও অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ কাজ। আলেমদের মতে, আর্থিক ইবাদত (দান) এবং দৈহিক ইবাদত (দোয়া, নফল নামাজ ও তেলাওয়াত) উভয় মাধ্যমেই মৃত ব্যক্তি উপকৃত হন। বিশেষ করে জুমার দিন বা রমজানে মায়ের জন্য নফল ইবাদত করে সওয়াব পৌঁছানো সন্তানের কর্তব্য।
মায়ের কবরে শান্তি পৌঁছানোর জন্য বড় কোনো অঢেল সম্পদের প্রয়োজন নেই; প্রয়োজন ইখলাস, আন্তরিকতা ও ধারাবাহিকতা। একটি নিয়মিত দোয়া, একটি ছোট স্থায়ী দান কিংবা আত্মীয়দের সাথে সুন্দর আচরণ এসবের মাধ্যমেই সন্তান মায়ের ঋণ কিছুটা শোধ করতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে মা-বাবার জন্য নেক সন্তান হিসেবে কবুল করুন। আমিন। এখন ঠিক আছে?

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: