কার্যকর উদ্যোগ নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের!
যত্রতত্র ইটভাটা, বিপর্যস্ত পরিবেশ
প্রকাশিত:
৩ অক্টোবর ২০২৩ ১০:৪৪
আপডেট:
১৩ নভেম্বর ২০২৪ ২০:২৬
পরিবেশ আইনের তোয়াক্কা না করেই সারাদেশে যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ইটভাটা বা ইটখোলা। এতে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে পড়ছে পরিবেশ। আর এসব ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাণীকূল, আবাদি জমি ও গাছপালা। কেবল তাই নয় ফুসফুসে ক্যান্সার, সর্দি, কাশি, হার্ট অ্যাটাকসহ নানা রোগে পতিত হচ্ছে মানুষ।
ইট তৈরির কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয় মাটি, কয়লা ও কাঠ। প্রতিবছর অক্টোবর থেকে শুরু করে মে পর্যন্ত টানা চলে ইট তৈরির কাজ। একবার ভাটায় আগুন জ্বালালে আর নেভানো হয় না। বছরের প্রায় ছয় থেকে সাত মাস ভাটায় কাঠ পুড়তে থাকে।
নিয়মানুযায়ী ভাটাগুলোতে পরিবেশ অধিদফতরসহ বিভিন্ন বিভাগের ছাড়পত্র সংগ্রহ করে অনুমোদন সাপেক্ষে কয়লা পুড়িয়ে ইট প্রস্তুতের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এ নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে বেশির ভাগ ভাটাতেই অবৈধভাবে তৈরি হচ্ছে ইট। এসব ইটভাটায় কাঠ পুড়িয়ে ইট প্রস্তুতের প্রতিযোগিতা চলছে রীতিমতো। যার প্রভাব পড়ছে কৃষিজমি, পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যে।
তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ ডেইলিমেইলকে বলেন, যারা অবৈধভাবে কিংবা পরিবেশ বিনষ্ট করে ইট প্রস্তুত করে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, আমাদের সারাদেশে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। জুলাই ২০২১ হতে জুন ২০২৩ পর্যন্ত ইটভাটার বিরুদ্ধে মোট ২৭৮ টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৬৮১ টি মামলা দায়ের করা হয় এবং আঠার কোটি আটাশ লক্ষ আটচল্লিশ হাজার পাঁচশত টাকা জরিমানা ধার্যপূর্বক আদায় করা হয়। অভিযানে ১৬৩ টি ইটভাটা ভেঙ্গে ফেলা বা কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সকল ইটভাটা যেন পুনরায় চালু করতে না পারে সে বিষয়ে অধীন জেলাসমূহে মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
জানা যায়, ইট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। দেশে প্রায় ৮ হাজারের বেশি ইটখোলা বা ইটভাটা রয়েছে। বছরে প্রায় ২৭ বিলিয়নের বেশি ইট বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। জিডিপিতে ইটশিল্প প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখছে। বছরে প্রায় ২০৫ বিলিয়ন টাকা ইট উৎপাদনকারী কারখানাগুলো থেকে জিডিপিতে যোগ হচ্ছে। ১৪ লাখেরও বেশি মানুষ দেশের ইটখোলাগুলোয় কর্মরত।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে ইটভাটার সংখ্যাও ১০ বছরে ২ থেকে ৩ শতাংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। বছরে প্রায় ৫ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন টন কয়লা ইটখোলাগুলোয় জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইট তৈরির কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয় মাটি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বছরে প্রায় ৩৩ হাজার ৫০ মিলিয়ন কিউবিক ফুট মাটি ইট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ইট তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে ফিক্সড চিমনি সবচেয়ে পুরোনো পদ্ধতি। এক্ষেত্রে ধোঁয়া নির্গমনের জন্য প্রায় ১২০ ফুট লম্বা চিমনি ব্যবহৃত হয়। ওই পদ্ধতিতে দেশে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ ইটখোলায় ইট উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। অন্যদিকে জিগজাগ, হাইব্রিড হফম্যান ও টানেল পদ্ধতিতেও ইট উৎপাদিত হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে টানেল পদ্ধতি সবচেয়ে আধুনিক এবং অনেকটা পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি, যদিও এ পদ্ধতিতে ইট উৎপাদনকারী কারখানার সংখ্যা খুবই কম।
বছরে পাঁচ থেকে ছয় মাস শুষ্ক মৌসুমে দেশে ইট উৎপাদিত হয়। বাকি মাসগুলোয় ইট উৎপাদনের কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ থাকে। শুষ্ক মৌসুমে একদিকে বায়ুন্ডলে ধুলাবালির প্রাদুর্ভাব, অন্যদিকে ইটখোলাগুলো থেকে নির্গত দূষিত উপাদানের প্রাদুর্ভাবে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, বছরে প্রায় ১৫ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড ইটখোলা থেকে বায়মুন্ডলে যোগ হচ্ছে। ইটখোলায় জ্বালানি হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে আমদানিকৃত নিম্নমানের কয়লা। এ কয়লা পোড়ানোয় প্রচুর পরিমাণে ছাই তৈরি হয়। অন্যদিকে ইটভাটা থেকে বায়ুমন্ডলে দূষিত উপাদানও যোগ হচ্ছে। এসব দূষিত উপাদানের মধ্যে পার্টিকুলেট ম্যাটার, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রতিনিয়ত বায়ুমন্ডলে নির্গত হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু উভয়ের জন্য পার্টিকুলেট ম্যাটার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ইটভাটা থেকে নির্গত এই দূষিত উপাদান মানবদেহে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে রেসপিরেটরি সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে ইটভাটার আশপাশে বসবাসরত মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বেশি দেখা যায়। গবেষণায় আরও পাওয়া যায়, বর্তমানে বায়ুতে পার্টিকুলেটস ম্যাটারের উপস্থিতিতে মানুষের মৃত্যুর হার আগের তুলনায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বায়ুতে মাত্রাতিরিক্ত সালফার ডাইঅক্সাইডের উপস্থিতির কারণে মানুষ চোখ, নাক, গলাসহ অ্যাজমাটিক সমস্যার সন্মুখীন হচ্ছে। মোটা দাগে বলা যেতে পারে, বায়ুতে দূষিত উপাদানের উপস্থিতিতে ফুসফুসে ক্যান্সার, হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর হার বেড়ে যাচ্ছে।বর্তমানে অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে অনেক আবাসিক এলাকায়ও ইটভাটা দেখা যায়। উদ্যোক্তারা আবাসিক জায়গা থেকে ইটখোলাগুলো সরিয়ে নিতে খুব একটা আগ্রহী নন। ফলে দেখা যাচ্ছে, ইটখোলার আশপাশে বসবাসরত মানুষ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ডেইলিমেইলকে বলেন, ইটখোলা থেকে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড একটি অন্যতম গ্রিনহাউস গ্যাস। অনবায়নযোগ্য জ্বালানি, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বনায়ন ধ্বংসের ফলে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ লাগামহীনভাবে বেড়েই চলছে। যদি অপরিকল্পিত ইটখোলা স্থাপনের কারণে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তাহলে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ অনেক বেড়ে যাবে। বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ দূষণে ইটভাটার ভূমিকাকে অস্বীকার করার উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন এ পরিবেশবিদ।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: