শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


ব্যক্তির অজান্তেই নিবন্ধন হচ্ছে মোবাইল সিম


প্রকাশিত:
৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৬:২২

আপডেট:
৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:১৬

ফাইল ছবি

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা নিজের নামে নিবন্ধন করে একটি মোবাইল সিম ব্যবহার করছেন দীর্ঘদিন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তার মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, তার নামে একই অপারেটরের আরেকটি সিম সক্রিয় রয়েছে এবং সেটি ব্যবহার করে প্রতারণা করা হয়েছে! এমন তথ্যে তিনি অবাক হন। শেষ পর্যন্ত প্রযুক্তিগত তদন্তে বেরিয়ে আসে, সিমটি তার নামে নিবন্ধিত হলেও এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

শুধু ওই ব্যক্তিই নন, তার মতো অনেকেই একটি সিম নিবন্ধন করে ব্যবহার করলেও অজান্তেই তাদের নামে সক্রিয় রয়েছে একাধিক মোবাইল সিম। আর এসব সিম ব্যবহার করে সংঘটিত হচ্ছে নানা ধরনের প্রতারণা, হুমকি এবং মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে অর্থ পাচারের মতো ঘটনাও। সম্প্রতি কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগের অভিযানে এ ধরনের একটি চক্র ধরা পড়ার পর বিষয়টি সামনে আসে।

সাইবার ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সিম নিবন্ধনের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় খুচরা ও গ্রাউন্ড প্রমোটররা ফাঁদ পেতে বসে আছে। একজন ব্যক্তি যখন এসব বিক্রেতার কাছে সিম কিনতে যান, তারা তখন ওই ব্যক্তির অজান্তেই তার নামে একাধিক সিমের নিবন্ধন রেখে দিচ্ছেন। ক্রেতার দেওয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিয়ে পরে সেই সিম তুলে সক্রিয় করে তা অপরাধীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে নিরপরাধ মানুষের যেমন হয়রানি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তেমনি মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেনসহ সার্বিক নিরাপত্তায় হুমকির সৃষ্টি হচ্ছে।

নিবন্ধন জালিয়াতি: অনুসন্ধানে জানা যায়, গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে সাইবার ক্রাইম বিভাগের ই-ফ্রড টিম মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। ঘটনাটি তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে প্রতারক চক্র অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা করে আসছে। এর পর সিলেট এবং রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে শাহাদাত শিকদার, জুয়েল হাওলাদার, হিমন আহমেদ, রুবেল আহমেদ ও অপু চন্দ্র দাস নামে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত কয়েক অপারেটরের ৫০৪টি সক্রিয় সিম জব্দ করা হয়।

ওই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া সাইবার ক্রাইম বিভাগের ই-ফ্রড টিমের লিডার সহকারী কমিশনার সুরঞ্জনা সাহা সমকালকে বলেন, প্রথমে সিলেটে অভিযান চালিয়ে হিমন আহমেদ, রুবেল আহমেদ ও অপু চন্দ্র দাসকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদের পেশা খুচরা সিম বিক্রি করা। কেউ সিম কিনতে গেলে মূলত এরাই কৌশলে এক ব্যক্তির নামে একটি সিমের জায়গায় একাধিক সিমের নিবন্ধন রেখে দেয়। এরপর এসব সিম তারা বেশি দামে প্রতারকদের হাতে তুলে দেয়। ওই তিনজনের তথ্যানুযায়ী শাহাদাত শিকদার ও জুয়েল হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরা ভুয়া নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা করে আসছিল। এ চক্রটি ফরিদপুর জেলার ভাঙার প্রতারক চক্র।

সুরঞ্জনা সাহা আরও জানান, অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম বিক্রেতা এবং এগুলো ব্যবহারকারীদের সমন্বয়ে একটা সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তারা যে গ্রুপকে ধরেছেন, তাদের মধ্যে প্রথম গ্রুপটা সিলেট থেকে সিম নিবন্ধন করিয়ে ভাঙা এলাকাকেন্দ্রিক প্রতারক চক্রের কাছে বিক্রি করে আসছিল।

সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডিজিটাল ফরেনসিক অ্যান্ড ই-ফ্রড টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আহসান হাবিব বলেন, একজন ব্যক্তি যখন সিম তুলতে গিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট (আঙুলের ছাপ) দিচ্ছেন, তখন অনেক সময় বিক্রেতা বলে থাকে, ছাপটি নেওয়া সম্ভব হয়নি বা ভালোভাবে হয়নি। তখন আবারও আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। আসলে এই কৌশলে সিম বিক্রেতা একজন ব্যক্তির কাছ থেকে দুই দফায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে রেখে দিল। ক্রেতাকে একটি সিম দিলেও বিক্রেতা পরে আরেকটি সিম তুলে রেখে দেয়। সে ক্ষেত্রে বিক্রেতা যে জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি দিয়েছিলেন, সেটির অন্য একটি কপি করে পরের সিমে তথ্য যুক্ত করা হয়। এভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্টের ফাঁদ পেতে ক্রেতার অজান্তে বা অজ্ঞাতেই দ্বিতীয় সিমটি তুলে দেওয়া হচ্ছে অপরাধী বা প্রতারকদের হাতে।

এই কর্মকর্তা বলেন, সিলেট অঞ্চলে চা বাগানের শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য সিমকার্ড এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাকাউন্ট দরকার হয়। ওই সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছে হিমন আহমেদ, রুবেল আহমেদ ও অপু চন্দ্র দাসের চক্রটি। এরা চা শ্রমিকদের অজ্ঞাতসারে তাদের নামে একাধিক সিম নিবন্ধন করে নেয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা সক্রিয় ৫০৪টি সিমের বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত চলছে।

তদন্ত সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার ওই তিনজন জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, গত সাত-আট মাসে অন্তত এক হাজার সিম ভুয়া নিবন্ধন করিয়ে প্রতারকদের কাছে বিক্রি করেছেন।

স্ট্যান্ডবাই সিম: গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা পুলিশকে বলেছেন, ডিস্ট্রিবিউশন প্রতিষ্ঠান থেকে সিম বিক্রির জন্য তাদের টার্গেট দিয়ে দেওয়া হয়। একজন গ্রাউন্ড প্রমোটর (মাঠ পর্যায়ে যিনি সিম বিক্রি করে থাকেন) বা খুচরা বিক্রেতাকে মাসে অন্তত দুইশ থেকে আড়াইশ সিম বিক্রির বাধ্যবাধকতা থাকে। টার্গেট পূরণ করতে পারলে তারা কমিশন পেয়ে থাকেন। টার্গেট পূরণ দেখাতে তারা এক ব্যক্তির নামে একাধিক সিম নিবন্ধন করে তা বিক্রি দেখিয়ে থাকেন।

রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের ফুটপাতে ও পাড়া-মহল্লায় গ্রাউন্ড প্রমোটররা বিভিন্ন অপারেটরের সিম বিক্রি করে থাকেন। সম্প্রতি তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করেও জানা গেছে, তারা প্রতি মাসে টার্গেটের ভিত্তিতে সিম বিক্রি করে থাকেন। ঢাকার গুলিস্তান এলাকায় অন্তত দু'জন খুচরা বিক্রেতার কাছে পরিচয় গোপন করে অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম কেনার আগ্রহ দেখালে তারা তাতে সায় দেন। তাৎক্ষণিকভাবে এ ধরনের সিম দিতে না পারলেও এজন্য অপেক্ষা করতে বলেন এবং একটি সিমের জন্য এক হাজার টাকা লাগতে পারে বলে তারা জানান। তাদের ভাষায় এগুলো 'স্ট্যান্ডবাই' সিম।

প্রতারণায় ব্যবহার: সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডিজিটাল ফরেনসিক অ্যান্ড ই-ফ্রড টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আহসান হাবিব বলছিলেন, অন্যের নামে নিবন্ধিত সিমের ক্রেতার বেশিরভাগই প্রতারক চক্রের সদস্য। এরা এসব সিম ব্যবহার করে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণাসহ নানা ধরনের প্রতারণা করে থাকে। প্রতারক চক্রটি অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম কেনার সময়ে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি এবং ছবিও নিয়ে থাকে। এরপর ওই মোবাইল নম্বরে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবি ব্যবহার করে দেশে প্রচলিত বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান থেকে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এরপর এসব অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে প্রতারণা করা হয়। প্রতারণা শেষে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর সিম ফেলে দেওয়া হয়। এ কারণেই এ চক্রটিকে আইনের আওতাও নেওয়া যাচ্ছে না।

সাইবার ক্রাইম বিভাগের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্তে দেখা যায়, নিবন্ধনে থাকা ব্যক্তি জানেনই না, তার নামে নিবন্ধন নিয়ে সেই সিমকার্ড ব্যবহার করে অপরাধ হচ্ছে। এতে আসল অপরাধীদের বড় একটা অংশ ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

অ্যামটবের বক্তব্য: মোবাইল অপারেটরদের সংগঠন অ্যামটবের মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এস এম ফরহাদ বলেন, দেশের মোবাইলফোন সেবাদাতারা সরকারের নির্দেশনা ও তত্ত্বাবধানে কোটি কোটি টাকা খরচ করে তাদের গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বায়োমেট্রিক সিম রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করেছে। এতে গ্রাহকদের নিরাপত্তা যেমন রক্ষা করা যায়, তেমনি ভোগান্তি কমেছে। সিম নিবন্ধন ও বিক্রির এত জটিল-কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্যেও কোনো রিটেইলার যদি কোনো গ্রাহককে বোকা বানিয়ে অন্যায়ভাবে সিম বিক্রি করে তবে দেশের আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটাই সংগত। মোবাইল সেবাদাতারা সবসময়ই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাই এ ব্যাপারে কোনো ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে অবশ্যই তা করা হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে অসদুপায় অবলম্বনের কারণে অপারেটররাই তাদের কিছু কিছু ডিস্ট্রিবিউটরের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার বক্তব্য: বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর শিকদার বলেন, এ ধরনের অপরাধের দায় মোবাইল অপরাটেরগুলোর। বিটিআরসির কাছে এ ধরনের অভিযোগ এলে সংশ্নিষ্ট সিমের অপারেটরের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগের ধরন বিবেচনায় সংশ্নিষ্ট অপারেটরকে শোকজ করা ছাড়াও প্রয়োজনে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়ে থাকে।

সূত্র : সমকাল



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top