রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিললেই গাজা উপকূলের 'গ্যাসের মালিকানা' পাবে ফিলিস্তিন
প্রকাশিত:
২২ জুলাই ২০২৫ ১১:২০
আপডেট:
২২ জুলাই ২০২৫ ১৭:৪৫

ফিলিস্তিনকে যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাহলে গাজা উপকূলের বিতর্কিত গ্যাসক্ষেত্র ‘গাজা মেরিন’-এর মালিকানা এবং গ্যাস উত্তোলনের পূর্ণ অধিকার পাবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। এমন মন্তব্য করেছেন খনিজসম্পদ বিশেষজ্ঞ মাইকেল ব্যারন। খবর দ্য গার্ডিয়ান।
ব্যারনের মতে, বর্তমান বাজারদরে গাজা মেরিন থেকে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার পর্যন্ত আয় সম্ভব। তিনি জানান, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর গড়ে ১০ কোটি ডলার রাজস্ব পেতে পারে এবং এ প্রবাহ ১৫ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। তিনি বলেন, 'এই আয়ে ফিলিস্তিন কাতার বা সিঙ্গাপুরে পরিণত না হলেও এটা তাদের নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করবে। তারা বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।'
প্রায় তিন দশক ধরে গাজা উপকূলবর্তী এই গ্যাসক্ষেত্রটির মালিকানা নিয়ে চলছে দ্বন্দ্ব। আইনি জটিলতায় অনুসন্ধান কার্যক্রম বহুদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় ফিলিস্তিনপন্থী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষে একটি আইনজীবী প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ইতালির রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি প্রতিষ্ঠান ইএনআই-কে একটি সতর্কীকরণ চিঠি পাঠায়। সেখানে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের জ্বালানি মন্ত্রণালয় যে ‘জোন জি’ অঞ্চল নির্ধারণ করেছে, তার ৬২ শতাংশই ফিলিস্তিনের দাবিকৃত জলসীমার অন্তর্ভুক্ত। অথচ সেখানে ছয়টি গ্যাস অনুসন্ধান লাইসেন্স ইসরায়েল ইতিমধ্যে দিয়ে ফেলেছে।
আইনজীবীরা যুক্তি দিয়েছেন, ইসরায়েলের এ ধরনের লাইসেন্স প্রদান আইনি বৈধতা হারায়। ব্যারনের ব্যাখ্যায়, যদি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং সেসব রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় যাদের এখতিয়ারে বড় তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলো নিবন্ধিত, তাহলে আইনি জটিলতা কার্যত শেষ হয়ে যাবে। এতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ একটি নিরাপদ ও টেকসই আয়ের উৎস পাবে এবং জ্বালানির জন্য আর ইসরায়েলের ওপর নির্ভর করতে হবে না।
২০১৫ সালে জাতিসংঘের সমুদ্র আইন–সংক্রান্ত কনভেনশন (আনক্লজ)-এ ফিলিস্তিন স্বাক্ষর করে এবং ২০১৯ সালে তারা তাদের সমুদ্রসীমা ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করে। যদিও ইসরায়েল এখনো এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি।
ইএনআই চিঠির প্রেক্ষিতে জানায়, এখন পর্যন্ত তারা কোনো লাইসেন্স গ্রহণ করেনি এবং অনুসন্ধান কার্যক্রমও শুরু হয়নি। এদিকে গাজা উপকূল বরাবর প্রায় ৯০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি গ্যাস পাইপলাইন ইসরায়েলের আশকেলন থেকে মিসরের আরিশ পর্যন্ত বিস্তৃত, যেখানে গ্যাস তরলীকরণ করে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হয়।
তবে গ্লোবাল উইটনেস নামের একটি সংস্থা অভিযোগ করেছে, এই পাইপলাইন ফিলিস্তিনের জলসীমা অতিক্রম করলেও, সেখান থেকে ফিলিস্তিন কোনো রাজস্ব পায় না। ব্যারন স্মরণ করিয়ে দেন, ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের জলসীমা, ভূগর্ভস্থ সম্পদ, আইন প্রণয়ন এবং গ্যাস অনুসন্ধান ও লাইসেন্স দেওয়ার অধিকার স্পষ্টভাবে স্বীকৃত হয়েছিল। ইয়াসির আরাফাতের রাষ্ট্র নির্মাণ পরিকল্পনায় এই সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ফিলিস্তিনিদের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতেই তাদের সম্পদের শোষণে যুক্ত হয়েছে, বলেন ব্যারন।
২০০০ সালে গাজা উপকূলে প্রথম গ্যাস আবিষ্কৃত হয়। এটি ছিল ব্রিটিশ গ্যাসের অংশীদারিত্বে পরিচালিত একটি প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য ছিল গাজার একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করে বিদ্যুৎ–সংকট দূর করা। কিন্তু গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিরা সেখান থেকে এক ফোঁটা গ্যাসও উত্তোলন করতে পারেনি।
ব্যারন বলেন, 'এই প্রকল্পের পরিণতিই ইসরায়েলের ফিলিস্তিন নীতির প্রতিচ্ছবি। তারা চায় ফিলিস্তিনিরা তাদের ওপর নির্ভর করুক, আবার চাই ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আটকে দিতে।' প্রকল্পের প্রথম প্রধান বাধা ছিল কে গ্যাস উত্তোলনের লাইসেন্স দিতে পারবে—এই প্রশ্নে। যেহেতু ফিলিস্তিন তখনো একটি পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্র নয়, তাই তাদের হাতে আইনি কর্তৃত্ব ছিল না। ইসরায়েলি আদালত একপর্যায়ে গাজা উপকূলীয় জলসীমাকে ঘোষণা করে ‘নো-ম্যানস ওয়াটার’—অর্থাৎ যার মালিকানা কারও নয়।
অসলো চুক্তিতে জলসীমা অধিকার স্বীকৃত হলেও সেখানে ২০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’-এর উল্লেখ ছিল না। চুক্তিটি ছিল একটি অস্থায়ী চুক্তি, ফলে স্পষ্ট সীমারেখা নির্ধারিত হয়নি। সাধারণভাবে উপকূল থেকে ১২ বা ২০ মাইল পর্যন্ত অঞ্চলকে বলা হয় ‘টেরিটোরিয়াল ওয়াটার’। গাজা মেরিন গ্যাসক্ষেত্র উপকূল থেকে ২০ মাইল দূরে অবস্থিত, যা নিয়ে ইসরায়েলের দাবি, এটি ফিলিস্তিনের নয়; বরং ‘উপহার’ হিসেবে দেওয়া হয়েছে।
২০০৭ সালে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নিলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। এরপর ইসরায়েল প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয় এবং ব্রিটিশ গ্যাসও প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। ২০২৩ সালে ইসরায়েল মিসরের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ইগ্যাসকে গাজা মেরিন প্রকল্পে কাজের অনুমতি দিলেও, গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ায় কাজ আবারও বন্ধ হয়ে যায়।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদক ফ্রানচেসকা আলবানিজ সম্প্রতি বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতের মতে, ইসরায়েলের দখল অবৈধ। তাই যে কোনো বেসরকারি বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এই দখলকৃত অঞ্চলে ব্যবসা বা বিনিয়োগ করলে তা বৈশ্বিক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। তিনি এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে সহায়ক পদক্ষেপে অংশ নেয়। তবে ইসরায়েল এ দাবি পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
ডিএম /সীমা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: