শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১


ডিভোর্সের টিকটক করে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন


প্রকাশিত:
৯ আগস্ট ২০২২ ২৩:৩৭

আপডেট:
২০ এপ্রিল ২০২৪ ১১:১১

 ছবি : সংগৃহীত

২৯ বছর বয়সী সানিয়া খানের জন্য ২১ জুলাই একটি ভুল সম্পর্কের ট্রমা থেকে বের হয়ে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরুর জন্য শিকাগো ত্যাগের কথা ছিল। কিন্তু তিনি টেনেসিতে ফিরলেন কফিনে।

তিনদিন আগে পুলিশ কর্মকর্তারা শিকাগোর কনডোমিনিয়ামের সামনের দরজার কাছে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেন তাকে। এক সময় ৩৬ বছর বয়সী স্বামী রাহীল আহমদের সঙ্গে এখানেই বসবাস করতেন সানিয়া। তার মাথার পিছন দিকে একটি গুলির আঘাত ছিল এবং কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলেই তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আহমদ নিজেও আত্মহত্যা করেন।

এই জঘন্য হত্যা-আত্মহত্যার ঘটনা ছিল তরুণ পাকিস্তানি-আমেরিকান ফটোগ্রাফার সানিয়া খানের জীবনের দুঃখজনক চূড়ান্ত অধ্যায়। সম্প্রতি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটকে পরিচিতি পেয়েছেন। দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটিতে বিয়ের মানসিক আঘাত এবং বিবাহ বিচ্ছেদ নিয়ে সামাজিক কলঙ্কের বিরুদ্ধে লড়াই করা নারীদের একজন কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন তিনি।

শিকাগো সান-টাইমস পুলিশের প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, সানিয়া ও রাহীল বিবাহ বিচ্ছেদ প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলেন। সানিয়ার কাছ থেকে দূরে অন্য অঙ্গরাজ্যে বাস করছিলেন রাহীল। ‘বিয়ে রক্ষা’ ৭০০ মাইল পাড়ি দিয়ে আগের বাড়িতে আসেন রাহীল।

সানিয়ার মৃত্যুতে তার বন্ধুরা বিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। তার অনলাইন ফলোয়ার ও দক্ষিণ এশীয় অপর নারীদের মধ্যে যারা মনে করেন পরিবারের খাতিরে অসুখী সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চাপ অনুভব করছেন তারাও একই সুরে কথা বলছেন।

তার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু ব্রিয়ানা উইলিয়ামস জানান, তিনি বলতেন ২৯-তম বছর হবে তার নিজের বছর এবং একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তিনি খুব উদ্দীপিত ছিলেন। বন্ধুদের কাছে সানিয়া ছিলেন আনন্দের উৎস- নির্ভেজাল, ইতিবাচক এবং নিঃস্বার্থ।

ইন্সটাগ্রামে সানিয়া নিজের প্রথম পাবলিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছিলেন। তিনি নিজের শখ হিসেবে ফটোগ্রাফি উল্লেখ করেছেন। জীবন সম্পর্কে সেখানে লিখেছেন, আমি মানুষকে নিজেকে এবং অপরকে ক্যামেরার সামনে ভালোবাসতে সহযোগিতা করি। বিয়ে, মাতৃত্ব, বেবি শাওয়ার ও জীবনের অন্যান্য মাইলফলক উদযাপনের ছবি তুলতেন।

মেহরু শেখ জানান, ক্যামেরার পেছনেই তিনি জীবন্ত হয়ে উঠতেন। আবেগ ও আনন্দ ধরে রাখতে ক্যামেরার সামনে মানুষকে স্বাভাবিক করে তোলার সহজাত প্রবৃত্তি তার ছিল। সানিয়া নিজের জীবনেও এমন আনন্দ চেয়েছিলেন। পাঁচ বছর আহমদের সঙ্গে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার পর ২০২১ সালের জুন মাসে তাকে বিয়ে করে শিকাগোতে চলে আসেন।

সানিয়ার বন্ধুদের দাবি, আহমদের দীর্ঘদিন ধরে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা ছিল। বিয়ের আগ পর্যন্ত এই দম্পতি মূলত দূরবর্তী সম্পর্কে ছিলেন। এটি হয়ত তাদের অসামঞ্জস্যতার বিষয়টিকে অস্পষ্ট করে ফেলে। গত বছর ডিসেম্বরে সমস্যা বড় হয়ে ওঠে। ওই সময় সানিয়া তাদের জানান, আহমদের মানসিক স্বাস্থ্য সংকট রয়েছে এবং তিনি নিরাপদবোধ করছেন না।

ভায়োলেন্স পলিসি সেন্টারের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সপ্তাহে এক ডজন হত্যা-আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এগুলোর দুই-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী জড়িত।

সঙ্গী দ্বারা নিপীড়নের শিকার নারীদের জন্য শীর্ষ ঝুঁকির বিষয় হিসেবে মানসিক অসুস্থতা ও সম্পর্কে জটিলতাকে প্রায়ই চিহ্নিত করা হয়। পারিবারিক নির্যাতন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্পর্ক ত্যাগ করতে গেলে ঘনিষ্ঠ সঙ্গী দ্বারা হত্যার বেশি ঝুঁকিতে থাকেন নারীরা।

সানিয়ার বন্ধুরা বলছেন, ডিসেম্বরের ঘটনার আগ পর্যন্ত নিজের অসুখী বিয়ে নিয়ে কিছু বলতেন না তিনি। ওই ঘটনার পর তিনি কথা বলতে শুরু করেন। সানিয়া খান নিজের বিয়ে নিয়ে সংকটের কথা আলোচনা করতেন। তাদের বলতেন যে, তার স্বামী ঘুমান না, প্রায়ই অদ্ভূত আচরণ করেন, সহযোগিতা নিতে বা থেরাপিতে যেতে চাইতেন না এবং তিনি মনে করতেন তার স্বাস্থ্য সমস্যা তার জন্য বোঝা হয়ে উঠছে।

সানিয়া দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটিতে বিবাহবিচ্ছেদের সামাজিক কলঙ্কের কারণে নারীদের কী পরিমাণ ভুক্তভোগী হতে হয় তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন। তার বাবা-মায়েরও বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে।

নিপীড়নের শিকার দক্ষিণ এশীয় নারীদের সংবেদনশীল সহযোগিতা প্রদানকারী শিকাগোভিত্তিক সংস্থা আপনা ঘর-এর নির্বাহী পরিচালক নেহা গিল বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারকে ঘিরে অনেক সাংস্কৃতিক চাপ থাকে। দক্ষিণ এশীয় অনেক কমিউনিটিতে এখনও নারীদের অধস্তন এবং নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করে। এই সংস্কৃতি অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক। ফলে এটি হলো ব্যক্তির নিরাপত্তা ও কল্যাণের চেয়ে পরিবার বা কমিউনিটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

কিন্তু বন্ধুদের সহযোগিতায় সানিয়া বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন এবং বিচ্ছেদ চূড়ান্ত করতে আগস্টে শুনানির দিন ধার্য হয়েছিল। তার বন্ধুরা জানান, তিনি একটি নিষেধাজ্ঞার আদেশের জন্যও আবেদন করেছিলেন এবং বাসার তালাও বদলে ফেলেছিলেন। কমিউনিটিতে নিজেকে ‘কালো ভেড়া’ হিসেবে উল্লেখ করে টিকটকে নিজের কাহিনী বলতে শুরু করেন তিনি।

তার একটি পোস্টে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশীয় নারী হিসেবে বিবাহবিচ্ছেদের অর্থ হলো আপনি জীবনে ব্যর্থ। আরেকটি পোস্টে তিনি বলেছেন, আমার পরিবার আমাকে বলেছে যে, আমি যদি স্বামীকে ত্যাগ করি তাহলে শয়তান জিতবে, আমি পতিতাদের মতো পোশাক পরিধান করি এবং আমি যদি নিজের শহরে ফিরি তাহলে তারা আমাকে হত্যা করবে।

হত্যার সময় পর্যন্ত টিকটকে ২০ হাজারের বেশি মানুষ সানিয়া খানকে ফলো করছিলেন। বিসমা পারভেজ (৩৫) নামের এক পাকিস্তানি-আমেরিকান মুসলিম নারী তাদের একজন। তিনি বলেন, আমার মনে আছে প্রথম যে ভিডিওতে তাকে আমি দেখি। আমি তার প্রার্থনা করি। এই পরিস্থিতিতে থাকা নারীদের ধৈর্য ধরতে বলা হয়। কিন্তু যে সম্পর্কে নিপীড়ন রয়েছে সেখানে ধৈর্য জবাব হতে পারে না।

সূত্র: বিবিসি



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top