শনিবার, ২৭শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১


অমর একুশে ২০২৪

ভাষার জন্মকথা ও আমাদের দায়িত্ব


প্রকাশিত:
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:১১

আপডেট:
২৭ এপ্রিল ২০২৪ ২০:৫৪

ছবি-সংগৃহীত

আমি একুশ দেখিনি। অগ্রজদের কাছে কেবল তার গল্প শুনেছি। গল্পের শব্দ, বাক্য, আর গাঁথুনিতে যেন দেখে নিয়েছি একুশের রক্তঝরা সকালটিকে। শুনেছি বিদ্রোহী মিছিলের গর্জন। চমকে উঠেছি পুলিশের গুলির তাণ্ডবে। যেন ছুঁয়ে দেখেছি, আমার ভাইয়ের রক্তে ভেজা রাজপথটি। আমার ভাষা, বাংলা ভাষার শব্দবন্ধ, একুশের একটি ছবি এঁকে দিয়েছে মানসপটে। ভাষার এমনই শক্তি। কেবল কতক শব্দের গাঁথুনিতে, একটি না দেখা অধ্যায়কে জীবন্ত করে তুলতে পারে সে, হাজার বছর পরেও। ভাষা আমার অস্তিত্বের প্রধান নির্ণায়ক বলে আমি মনে করি। তবে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। কী করে ভাষার জন্ম হয়? ভাষার কাঠামো বা ব্যাকরণ রূপ নেয় কীভাবে? ভাষার কি রূপান্তর হতে পারে, না তা স্থবির? ভাষা কি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি-প্রসূত না কোনো বিশেষ ব্যক্তিবর্গ, পারিষদ, কিংবা গোষ্ঠী ভাষা তৈরি করে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। এতে আমার মায়ের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা আর তা সংরক্ষণের দায়িত্ববোধ, দুইই বলিষ্ঠতর হবে।

কাল থেকে কালান্তরে, মানুষে-মানুষে যোগাযোগের তাগিদেই ভাষার জন্ম। পৃথিবীতে আজ অবধি এমন কোনো গোত্রের আবিষ্কার হয়নি, যা ভাষাহীন; সে সুদূর আলাস্কার ইনুপিয়াকরা হোক, কিংবা হোক অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী উইরাজুরি জনগোষ্ঠী, অথবা বাংলাদেশের খেটে খাওয়া সহজিয়া মানুষ– সকলেরই মনের ভাব প্রকাশ করবার, একে অপরের যাতনার ভাগীদার হবার, আনন্দের সাথি হবার, প্রধানতম মাধ্যম এই ভাষা। এ ভাষা কেবল সে জনগোষ্ঠীর ভাষা। এ ভাষায় “মা” না ডাকলে যেন প্রাণ জুড়োয় না। এ ভাষাতে কেবল তার আপনজনেরা কথা বলে। একজন ধনশালীর যে ভাষা, নিঃস্বেরও সে একই ভাষা। ভাষা পৃথিবীতে তার পরিচিতির প্রথম এবং প্রধান ইঙ্গিত।

ভাষা সৃষ্টির তত্ত্ব পাল্টেছে ১৯৬০ সালের দিকে, নোম চমস্কির গবেষণার মধ্য দিয়ে। যদিও সাত শতক থেকেই ভাষা গঠনের কৌশল নিয়ে গবেষণা চলেছে, ১৯৫০-এর দশকে প্রথম একটি সুগঠিত তত্ত্বের উপস্থাপন ঘটে। বি. এফ. স্কিনার ভাষার আচরণগত তত্ত্বে বলছেন যে ভাষা একটি অধিগত প্রতিক্রিয়া বা লার্নড রেসপন্স। অর্থাৎ ভাষা মানুষের আচরণেরই একটি বিশেষ বহিঃপ্রকাশ আর আচরণের সাথে সাথে তা পাল্টায়। চমস্কি এক দশক পর লিঙ্গুইস্টিক থিওরি নামের নতুন ভাষাতত্ত্বের অবতারণা করেন। এ তত্ত্বানুসারে, ভাষা শেখার কিছু সহজাত নিয়ম রয়েছে; যা সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থানভেদে অভিন্ন। এই নিয়মগুলো মানব মস্তিষ্কের ভাষা অধিগ্রহণ (অ্যাকুইজিশন) যন্ত্রে গ্রথিত। ক্লাসিক্যাল ভাষাতত্ত্ব মতে যে কোনো ভাষার চারটি উপাদান রয়েছে: (১) ধ্বনিবিদ্যা– কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনির সমন্বয়ে ফোনিম তৈরির প্রক্রিয়া; (২) শব্দার্থবিদ্যা বা সিমান্টিক্স– শব্দ ও শব্দবন্ধের মানে নির্দিষ্টকারী প্রক্রিয়া; (৩) ব্যাকরণ– শব্দসমেত অর্থবহ বাক্য গঠনের নিয়ম নির্ধারক; এবং (৪) ব্যবহার্যতা– সামাজিক পরিস্থিতি ভেদে বাক্য ব্যবহারের ধরন তৈরিকারী উপাদান। এ কথা ভাবলে অবাক হতে হয় যে মানবকণ্ঠ মোটের ওপর ৫০টি ধ্বনি নিঃসরণ করতে সক্ষম, যা কিনা বিশ্বব্যাপী ৩ হাজার ভাষার সকল শব্দগঠনের মূল উপকরণ। অন্যদিকে চমস্কি, ভাষা কাঠামোর মূল উপাদানগুলোকে দুটো স্তরে বিভক্ত করেছেন– গভীর কাঠামো এবং পৃষ্ঠতলগত কাঠামো। ভাষার প্রথম তিনটি উপাদানই গভীর কাঠামোতে অবস্থান করে আর তার ব্যবহার্যতাই কেবল পৃষ্ঠতল কাঠামোতে প্রতিভাত হয়। নব্বইয়ের দশকে ‘অন ল্যাঙ্গুয়েজ’ গ্রন্থে চমস্কি তাঁর কাঠামোগত বিন্যাসকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করেন। ভাষাকে বিবৃত করবার দুটো ফর্মকে তিনি চিহ্নিত করেন– অর্থাৎ যৌক্তিক ফর্ম ও ধ্বনিগত ফর্ম। মোটের ওপর, ভাষা বিষয়ে চমস্কির মূল উপপাদ্য হলো এই যে, ভাষা মানুষের সহজাত এবং সকল ভাষার জন্ম কথোপকথনের ও ভাবের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে ঘটে থাকে।

চমস্কির এ অভিনব তত্ত্বের পর গত কয়েক দশক ধরেই ভাষার উৎপত্তি ও প্রসারের প্রক্রিয়া নিয়ে কগনিটিভ বিজ্ঞান গবেষণা করে আসছে। ভাষার জন্ম ও গঠন বিষয়ে দুটি প্রান্তবর্তী উদাহরণ দেবার প্রয়োজন দেখছি। ভিন্ন ভাষাভাষীর একদল মানুষ একত্র হয়ে কোনো কাজ সম্পাদনে বাধ্য হলে, এমনই একটি প্রান্তবর্তী পরিস্থিতি জন্ম হয়। ১৬ থেকে ১৯ শতকের ট্রান্স-আটলান্টিক দাস লেনদেনে ভিন্ন মহাদেশীয় মানুষদের উত্তর আমেরিকায় স্থানান্তর এবং আখ চাষে নিয়োজিতকরণ ভাষা বিনিময়ের একটি উর্বর ক্ষেত্রের সূচনা করে। হালে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের আখচাষিদের নিয়ে একটি সুপরিকল্পিত অনুসন্ধান চালানো হয়। ১৯ শতকের শেষদিকে হাওয়াইতে আখ চাষ বাড়তে থাকে। স্থানীয় চাষিরা এর সাথে তাল মেলাতে যখন হিমশিম খাচ্ছিলেন তখন ট্রান্স-প্যাসিফিক দাস লেনদেন শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন, জাপান, কোরিয়া ও ফিলিপাইনের ভেতর। সেই ভিনদেশি মানুষগুলো একে অপরের ভাষা বুঝতেন না। কিন্তু একই আখের বাগানে যে কাজ করতেই হবে তাদের, একসাথে। চীনা, জাপানি, কোরীয়, ফিলিপিনো, কিংবা ইংরেজি ভাষা শেখবার সময়ও নেই। অগত্যা, জীবনের প্রয়োজনে, অন্যদেশীয় ভাষার শব্দ আহরণ করতে শুরু করেন দাসেরা। যেন একপাত্রে নানা ভাষার শব্দ-টুকরো ঢেলে দেয়া হয়েছে; প্রয়োজনে এ শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহার করা যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় অসংলগ্নভাবে একটি নতুন ভাষা জন্ম নিতে শুরু করে। এমন অবিন্যস্ত ভাষাকে বলা হয়ে থাকে ‘পিজিন’। প্রখ্যাত মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ স্টিভেন পিঙ্কার ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিঙ্কট’ গ্রন্থে এর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। এই নব্য আগত আখচাষিরা যখন ঘর বাঁধেন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে, আর সেখানে জন্ম নেয় তাদের পরবর্তী প্রজন্ম, তখন সেই শিশুরা বেড়ে ওঠে বিভিন্ন ভাষা থেকে সংগৃহীত শব্দমালার ভিড়ে গড়ে ওঠা পিজিনের সাথে। এই দাসশিশুরা তখন ভাষা গঠনের অন্যান্য স্তর দিয়ে পিজিনটিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং তাকে রূপান্তর করে একটি সুবিন্যস্ত ‘ক্রিয়োল’ ভাষায়। আর এভাবেই জন্ম নেয় নতুন একটি ভাষা।

ভাষা জন্মের এই প্রক্রিয়া থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, মানুষ কথোপকথনের চাহিদা থেকে, একে অপরের সাথে যোগাযোগের আবশ্যকতা থেকে, শব্দ আহরণ থেকে শুরু করে একটি পরিপূর্ণ ভাষার জন্ম পর্যন্ত দিতে সক্ষম। ভাষা তাই স্থবির নয়। একটি গতিশীল আদান-প্রদানের মাঝে এর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। আমাদের ভাষাও তেমনি একটি গতিশীল স্রোতস্বিনী, যা হাজার বছরের পরিক্রমাতে ঋদ্ধ। তবে এ কথা মানতে হবে যে এ গতিশীলতা আজকের বাঙালির ওপর একটি বিশেষ দায়িত্ব সমর্পণ করেছে। আজকের প্রজন্ম কিংবা আগামীর শিশুদের সামনে ভাষার যে সুধাপাত্র উপস্থাপিত হবে, তাতে শব্দমালার যে মিশেল তুলে ধরা হবে সে ভাষা, সে শব্দসম্ভারই তাদের সম্বল। তাই আমাদের ওপর দায়িত্ব বর্তায় যে কোনো শব্দবন্ধের ব্যবহারে আমরা কথা বলব, প্রমিত না অপ্রমিত?

আমরা কি সমৃদ্ধ বাংলার ঋদ্ধ শব্দভান্ডারকে করব না অলস ভাষার উপস্থাপন করব আগামী প্রজন্মের কাছে? আজকের কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার আর কথাশিল্পীদের সতর্ক শব্দ চয়ন আর ভাষার ব্যবহার, আগামীর বাংলা ভাষার ভিতকে আরও সুদৃঢ় করবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে আমাদের প্রাণের ভাষার প্রাসাদে চির ধরতে পারে, এ আশঙ্কা যে অমূলক নয়।

এ তো গেল কথিত ভাষার কথা। ভাষার লেখনলিপি বা স্ক্রিপ্টের আবিষ্কার ভাষাকে স্থায়িত্ব দিয়েছে। তবে প্রথম স্ক্রিপ্টের পেছনের কারণ বেশ হতাশাব্যঞ্জক। ইউভাল হারারি তাঁর ‘সেপিয়েন্স’ গ্রন্থে বলেছেন, যে আজ থেকে ৫ হাজার বছর আগে, প্রথম সুমেরীয় স্ক্রিপ্টের প্রবর্তন হয়েছিল কোনো মহাকাব্যকে অমর করে রাখবার জন্য নয়, বরং প্রজাসাধারণের কাছ থেকে কর আদায়ের উদ্দেশ্যে। লাতিন স্ক্রিপ্ট আর হায়ারোগ্লিফের ইতিহাসও অনেকটা একই। তাই কোনো প্রাচীন কাব্যের ভাষা ব্যবহারের মূল্যমান আজকের বিচারে কী, তা দিয়ে ভাষার তুলনা করা বাতুলতা মাত্র। কথিত ভাষার প্রকাশের মাধ্যম লিখিত স্ক্রিপ্ট, কোনো ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব বিচারে সমর্থ হতে পারে না।

অন্য কথায় বলতে গেলে, একটি ভাষার সাথে আরেকটি ভাষার তুলনা করা কূপমণ্ডূকতার পরিচয় দেয়া মাত্র। বাংলা আমার মায়ের ভাষা। মায়ের কাছে শেখা বাংলা “মাদারিজ” আমার প্রথম বুলি। এ ভাষাতেই আমি স্বপ্ন দেখি, সৃষ্টির উচ্ছলতায় বিহ্বল হই, প্রেমের ভাবনায় হই আত্মহারা। এ ভাষা আমার পরিচয় আর অস্তিত্বের প্রথম প্রকাশ। যে বা যারা এ ভাষাভাষীর, তারা আমার মানুষ, একান্ত আপনজন। সুদূর প্রবাসে বসে, বাংলায় নিজেকে নিমজ্জনের যে সাধ জাগে, তা আমার সহজাত। ইংরেজি ভাষার ইতিহাস যতই পুরাতন আর ঋজু হোক না কেন, তাতে আমার হৃদয় আন্দোলিত হয় না। লাতিন বা ফরাসি ভাষায় যে গ্রন্থই রচিত হোক না কেন, তাতে আমি বিহ্বল হই না। আজ মহান একুশের প্রহরে দাঁড়িয়ে তাই সকল বাঙালির কাছে এই দাবি জানাই– আমাদের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান আর ভালোবাসা প্রকাশের দায়িত্ব আমাদের। প্রমিত শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এ ভাষার সংরক্ষণের কর্তব্যও আমাদের। মায়ের ভাষার জন্য এটুকুই কেবল সবিনয়, সামান্য নিবেদন।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


রিসোর্সফুল পল্টন সিটি (১১ তলা) ৫১-৫১/এ, পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল: ০১৭১১-৯৫০৫৬২, ০১৯১২-১৬৩৮২২
ইমেইল : [email protected], [email protected]
সম্পাদক: মো. জেহাদ হোসেন চৌধুরী

রংধনু মিডিয়া লিমিটেড এর একটি প্রতিষ্ঠান।

Developed with by
Top